Header Ads

Header ADS

আমি ও জোসনা বিষয়ক জটিলতা_আফসার নিজাম

 
আমি ও জোসনা বিষয়ক জটিলতা
আফসার নিজাম



প্রথম আমি দ্বিতীয় আমি’র ক্রমা
ক্রমশ আমি আমার ভেতর আরেকটা আমি’র আমিত্ব অনুভব করি। আমার থেকে যে আমি সৃষ্টি হয়, সে আমারি রূপ ধারণ করে আমাদের দহলিজে ঘুরে। আম্মা ওকে আমার-ই নাম ধরে ডাকে। কাছে টেনে কপালে চুম দেয়। গায়ে হাত বুলিয়ে সুরা ফাতেহা পড়ে ফুঁ দেয়। আমি আমার আগুনে জ্বলে উঠি। কিতাব থেকে চোখ ফিরিয়ে চিৎকার করি। ‘আম্মা ও আমি নই।’ আমি- আমার টেবিলে লক্ষ্য করি। অস্থির হয়ে ওঠে ওর চোখের মণি। মুখে বিড়বিড় করে আর অদৃশ্য হাতের তলোয়ার বাগিয়ে তালিম নেয়। তার তলোয়ারের কসরত বাতাসের দেহ কেটে ঘুরতে থাকে সারা দহলিজ। আমি ওকে বলি, ‘আয়, আমরা একসাথে মিশে যাই।’ ও শোনে না। ও ঘুরতে থাকে। ও তলোয়ার চালাতে থাকে। ও ঘুরতে থাকে ... তলোয়ার চালাতে থাকে।

আমাদের দহলিজের কারুকাজ বেরসিক বৃষ্টির সৃষ্টি, শ্যাওলা নোনা ধরে পিচ্ছিল। অসতর্ক হাঁটতেই পায়ে চাকা লেগে যায়। বাড়ির পেছনে আমাদের পুকুর নামধারণকারী পরত্যক্ত পানির ডোবায় খেলা করে হাঁসের বংশধর। কচুরিপানার নিচে মিথুন করে বিবাহিত মাছের দম্পতি। বীরিকুল গাছের সামনে দিয়ে যেতেই সেই পোড়োবাড়ি। ছাদহীন। পলেস্তরা ওঠে ইট দাঁত কেলিয়ে হাসছে। একটু ঝোপঝাড়, চামচিকার আর্ত ওড়াওড়ি, সাপদম্পতি এর ভিতর ফণা তুলে, আমি সবুজ ঘাসগালিচা দেখে বসে পড়ি।



আমার ভেতর থেকে আমার ‘আমি’ বের হয়ে যায়। সে দুরন্ত-অস্থির। দীর্ঘদিন ওর সাথে বসবাস করে আমি ওকে চিনে গেছি। ও বসে থাকার নয়। দুষ্ট বালকের মতো অবাধ্য, কপট অভিমান ও মজ্জাগত। ওকে আমি কবি বলে ডাকি। কবি’রা বাউল, কবি’রা ভ্রমণপ্রিয়, কবি’রা অদৃশ্য দেখে, কবি’রাই পারে হাজার বছরের অতীত কিংবা ভবিষ্যতে চলে যেতে। মনের বিড়বিড় আবৃত্তি করতে করতে পোড়োবাড়ির ভিতর কবি প্রবেশ করে। তলোয়ার কসরত করে এগিয়ে যায় পোড়োবাড়ির বড়মেয়ের জেনানার’র দিকে।

সম্ভবত পোড়োবাড়ির ভিতরে কেউ আসে না। শুধু ফোরকানিয়া মাদরাসার পারভেজ ও তার দল ছাড়া। তারা এসেই নিরবতার দেহে চাবুক কষে। অভিযান চালায় জালালি কবুতরের গোপন কুঠরিতে। ভয়ে আর্তচিৎকার করে চামচিকা। আমার ‘আমি’ মানে কবি রেগে আগুন হয়ে যায়। সম্ভবত পারভেজদের চিৎকারে শাহনাজের ঘুম ভেঙে যায়। কবি লাফিয়ে ওঠে তলোয়ার কসরত করতে থাকে। আমি বলি রাগ করো না। চেষ্টা করে যাও, আর চলো আমরা এক হয়ে যাই।

কবি আমাতে মিশে যেতে চায়। কিন্তু পূর্ণিমারাত জোসনা আলোতে দুরন্ত হয়ে ওঠে। ও অস্থির পায়চারী করে। বাতাসের ঢেউ ভেঙে ভেঙে দূর থেকে কার পায়ের নূপুর রিনিঝিনি ভেসে আসে। ঝুম...ঝুম...ঝুম...

কবি’র তলোয়ার কসরতে জোসনা টুকরো টুকরো হয়ে ঝরে পড়ে মর্তলোকের পলিতে। বাতাস কাটার হিসহিস সাপের আক্রোশে মিশে যায় দূর নীলিমায়। আবার কবি দহলিজ ছেড়ে কারো কারো স্বপ্নের মাঝে লাফিয়ে পড়ে। তখন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় তোমার। বিস্ময়ে আঁৎকে ওঠো তুমি। এখন কবি ক্লান্ত। হাঁটছে। জোসনার আলো আঁধারী মায়াডোরে।

সতর্ক দৃষ্টির চলমান ফেরেস্তা
ভোরের প্রথম মুয়াজ্জিন আজান দেয়ার সাথে সাথেই ফজরের মেরাজ করে নেই। রেহাল বিছিয়ে তিলাওয়াতে মন উড়ে যায়। মক্তবের পড়ায় মন দেই। কবি’র মক্তবের পড়ায় মন নেই, বালিশের তলদেশ থেকে বের করে... হাসসান বিন সাবিত, রুমি, হাফিজ, গালিব, নজরুল, ফররুখ, মল্লিক যতোগুলো নাম খুলে ততোগুলো আলো জ্বলে ওঠে। আমি ভয়ে বিমূঢ় হয়ে যাই। আম্মা দেখলেই রেগে যাবেন।

আমার স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে থাকে তাহলে আমি আমার অতীতকে প্রকাশ করছি সততার দাঁড়িপাল্লায়। তারপর আমি দহলিজ পেরিয়ে বড় বাস্তার গুলফাম গাছের দৃশ্য উপভোগ করি। আমার আম্মা, সে এমনি দৃষ্টিসম্পন্ন যে, আমার প্রতিটি পদক্ষেপ পড়তে পারে। তিনি আমার জন্য পশ্চিমে বাইতুল হারামকে মানত করে রেখেছেন। উত্তরে তুরাগ, দক্ষিণে রাজধানী এবঙ পূর্বে পীরের দরগা। জুমা শুরুর আগেই মসজিদের খেদমতের জন্য এলার্ড হয়ে যাই। আর সতর্ক দৃষ্টি রাখি আমার ‘আমি’ যেনো বের না হয়ে যায়। তীক্ষ্মভাবে দেখে নেই মসজিদের কোথাও কোনো অপবিত্রতা লুকিয়ে আছে কিনা। চমৎকারভাবে করলাম মসজিদ পরিষ্কার। যেনো আম্মা সবার কাছে শুনতে পান সর্বোচ্চ সতর্কতার সহিত আল্লাহতা’লার ঘরের সেবা করেছি।

মসজিদের দক্ষিণ পাশে ঝোপঝাড় হওয়া একটি পুরনো রাস্তা পোড়োবাড়ি হয়ে কোথায় চলে গেছে আমার কিশোর পা তখনও তার শেষ জানতে পারে নাই। আর এখনতো কোথাও যাওয়ার অবস্থা নেই। আব্বা ইন্তেকাল করলেন বারো ফেব্রুয়ারি দুই হাজার এক-এ। আম্মা একা। আমি না থাকলে তিনি তাঁর সমস্যা নিয়ে কুড়ে কুড়ে মরবেন। তাই আব্বার নিজ হাতে তৈরি খাটে নিজকে সেঁটে রাখি। আর আমার ‘আমি’ বারবার ছুটে যায় পোড়োবাড়ি। প্রতি রাতেই কবি ঘ্রাণ পায় নৈশভোজের। সবাই যখন নৈশভেঅজে মগ্ন, কবি সেই মুহূর্তে খোলা দরজার পর্দা উড়িয়ে দেয়।

সূর্য মাথার উপর। জোহরের সময় ছুঁউ ছুঁই। আম্মা দেখলেই জানতে চাইবে গোসল হয়েছে কী না। আজান দেয়ার জন্য পবিত্রতা অর্জন কতোটুকু! নামাজ শেষ। কোরআন তালিম দিতে বসেন হুজুর। হুজুর সুযোগ খোঁজেন। অবশেষে তিনি চলে যেতে সক্ষম হন। দ্বিতীয় হুজুর প্রথম হুজুরে রূপান্তরিত হই। আমার ‘আমি’ পিঞ্জিরা’র চাবি খুলে বের হয়ে যান। চলমান ফেরেস্তাদের মতো তদারকি করতে থাকে এলেম গ্রহণকারীদের। হঠাৎ আমার ‘আমি’ থতকে দাঁড়ায়। মেয়েটি পড়ে... ‘আলিম লাম মীম’ কবি’র উপস্থিতি টের পেয়ে দোপাট্টা টেনে হাসিতে মুক্তো ছড়িয়ে দেয় কিশোরী। এভাবে বিকেল রাস্তায় নামলে চলমান রহমতের ফেরেস্তা গায় গান... ‘মারহাবা ইয়অ মারহাবা’।

সন্ধ্যানক্ষত্র জাগার আগেই মুয়াজ্জিন হয়ে যাই। কোরআন তিলাওয়াতে পবিত্র করে তুলি এলাকার পরিবেশ। তারপর রাতের বয়স বাড়তেই আম্মা বসেন পিঠা বানাতে। আমি এবঙ ছোটরা তাকে ঘিরে ধোঁয়াওঠা পিঠার দেহ ভক্ষণ করি। আম্মা তার সভাবসুলভ মুগ্ধতায় বলেন, ‘শোনো বাচ্চারা! তোমাদের একটা গল্প শোনাই’। আমরা যারা এ আসরে খাদক এবঙ শ্রোতা সবাই আনন্দে উচ্ছ্বল হয়ে উঠি। ‘শোনো’ বলে তিনি বলতে আরম্ভ করেন। আমাদের কান খরগোশের মতো সতর্ক হয়ে উঠলো প্রতিটি শব্দ ক্যাচ করার জন্য। ‘নবী সোলায়মান আ.কে খোদাতা’লা সারাজাহানের বাদশা করেছেন। তাঁর কাছে পৃথিবীর অন্যান্য রাজারা বশ্যত স্বীকার করে। কিন্তু! কিন্তু!’ বলেই পিঠা উল্টাতে মনোযোগ দেন। এ সময়ে আমাদের গল্প শোনার চাহিদা আকাশ স্পর্শ করে। আমরা বলি ‘কিন্তু কী’! কাজ শেষে আম্মা শুরু করেন, ‘বিলকিস নামে এক রাণী ছিলো সে সময়। সে ছিলো ইয়েমেন বাদশার উত্তরাধিকারী এবঙ অবিবাহিতা। রাজ্য সুরক্ষার জন্য তার ছিলো শক্তিশালী সৈন্য বাহিনী। তার সৈন্যবল এমন ছিলো যে, তার সীমানার পাশের রাজারা তার বশ্যতা গ্রহণ করে। সে যে প্রতাপশালী রাণী, এ সংবাদ সোলায়মান আ. পেলেন তাঁর ব্যক্তিগত দূত হুদহুদ পাখির দ্বারা।’ হুদহুদ পাখি আবার দূত হয় কিভাবে? আমার ভেতরের ‘আমি’ বের হয়ে প্রশ্ন করলো। রেগে গেলেন আম্মা। ‘গল্প বলার সময় প্রশ্ন করতে নেই’। আম্মা আবার শুরু করেন, ‘সোলায়মান আ. তাকে প্রস্তাব করলেন এক আল্লাহর উপর ঈমান আনার জন্য। প্রথমে সে না মানলেও পরবর্তীতে সে মেনে নেয় এবঙ সোলায়মান আ.কে বিয়ে করে। রাণী বিলকিস ছিলো সোলায়মান আ. এর সবচেয়ে সুন্দরী বউ।’ আমার ‘আমি’ আর গল্প শুনতে চায় না। কবিমন চঞ্চল হয়ে ওঠে। আজ পূর্ণিমা। সরা দহলিজ জুড়ে জোসনা আলোর ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। আমার আমিকে আর কেউ দেখতে পায় না। তলোয়ার কসরত করতে করতে সে ছুটে যায় পোড়োবাড়ি প্রাঙ্গণে। তখন নূপুরের রিনিঝিনি নিক্কণ পায়ের তালে তালে বেজেই যাচ্ছে ঝুম...ঝুম...ঝুম...

সন্ধ্যাক্রান্তিরে শ্লথ পরিক্রমা
এই যে আমি, আমারি অবয়ব দেখতে পাই। এ যে আমারি আমি। প্রচন্ড বৈরিতার মধ্যেও সে তার জায়গা করে নেয় আমারি ভেতর। আর সম্ভবত প্রতিটি মানুষের জন্যই এই সত্যটা গ্রহণীয়। আমি যখন কল্পনা করি তখন আমার আমিত্বই অনুভব করি। কবি রেগে যায়। সে তার ভংগিমা প্রকাশ করে বলে, তবে শর্ত থাকে যে, নাস্তিক বা বাস্তবতা সম্বন্ধে যারা দ্বিধাবিভক্ত তারা কখনোই কবি হতে পারে না। তাদের আমার ‘আমি’ হারিয়ে যায়। আমি বলি তাবে তারাও কবি হতে পারে করিওগ্রাফির মতো।

আমার আমি’কে নিয়ে আমি সর্বদা চিন্তিত থাকি। সে বড়ই স্পর্শকাতর। আর আমি যখন হতাশায় নিমজ্জিত হই। দ্বান্দ্বিকতাকে প্রশ্রয় দিতে থাকি। তখন আমার কবি হয়ে যায় বেঁটেঅ সে গুটিয়েং যায় আমারই মধ্যে। পাখা ভেঙে পড়ে আজাজিল ফেরেস্তার মতো।

আমার আমি কখনও প্রৌড় হয় না। সে অনন্ত যৌবনা, আমাদের জীবন পৌঁছে গেলে সন্ধাক্রান্তি শ্লথ পরিক্রমায়; তখন কবি যৌবনদৃপ্তভাবে ঘোড়সাওয়ার হয়ে চষে ফিরবে তাবৎ দুনিয়া। আমি যখন চলে যাবো, এই কবি-ই আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে অনন্ত সময়। আমার প্রশংসা শুনে কবি উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। তার হাসি কাচভাঙা টুকরার মতো ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত দহলিজ। অন্দর মহলে আম্মা ঘুমুচ্ছে। তিনি জেগে গেলে গুনাহ হবে। ওকে বলি থাম! কাছে আয়, তোকে শোনাই তোর প্রশংসা। ও আজানের শব্দের মতো উড়ে যায়। দূরে যায়, উড়ে যায়, দূরে যায়...

কবি’রা মহান। কবি’রা ইতিহাস। কবি’রা সূফী। কবি’রাই দরবেশ তাই কবিদের হেয় করতে নেই। কবিদের ঠাট্টা করতে নেই। কবিদের অবহেলা করতে নেই। তাহলে জীবনে পাপ হয়। আর এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত এতো কঠিন যে, সে তার মৃত্যু নিজেই আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে।

আমার আমি’র উল্লাস থেকে অপেক্ষাকৃত নিরবতাই প্রিয়। মাঝে মধ্যে আমার নিজের আলো-আঁধারিতে দ্বিধাবিভক্ত। ত্রিভঙ্গুর-বহুভঙ্গুর চিন্তার আড়ালে, কবি প্রচ্ছায়অর মধ্যে গুটিয়ে যায়। এই যে আমার ভঙ্গুর চিন্তা, চেতনার জটাজাল ছিঁড়ে কবি কখন যে আনমনে হৃদয়ের দরজা খুলে বেড়িয়ে পড়ে তা আমি হয়তো জানি, হয়তো জানি না। এই যে আমার ‘আমি’ জীবনের সকল সৌন্দর্য নিয়ে সেই পোড়োবাড়ির দরজার কড়া নাড়ছে তো নাড়ছেই। রাজকন্যা যেনো মরণঘুমে নিমগ্ন। আমি ওকে বলি থাক, ঘুমাক শাহনাজ। আয়, আমরা মিশে যাই।

একগাছি নূপুরের নান্দনিক সৌন্দর্য
আজ জোসনা প্লাবনে ভেসে যাচ্ছে গ্রাম-নগর-বন্দর-রাজধানী। আবার সেই নূপুরের নিক্কণ। আমার ‘আমি’ চঞ্চল হয়ে ওঠে। নূপুরের মায়াবী সুর কবিকে দহলিজ থেকে বের করে নেয় পোড়োবাড়িমুখী রাস্তায়। আজ পোড়োবাড়ি যেনো উৎসব, জলসায় কবিতার জোয়ার ওঠে মুর্হূমুহূ ‘মারহাবা! মারহাবা!! ক্যায়া শায়ের’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে জলসাঘর।

মধ্যরাত। তবু তাদের আনন্দ হাসি পদ্মার ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ে। বাইরে আমার ‘আমি’ পাগল হয়ে যায়। জোসনা খেয়ে খেয়ে কবি ঢুকে যায় উৎসবে, পাহারাদারের চোখ ফাঁকি দিয়ে। ছুটে যায় সেই কামরায়। শাহনাজ! শাহনাজ!! বলে জড়িয়ে ধরে। তখন একটি আর্তচিৎকার বাতাসের ঢেউ ভেঙে ভেঙে দূর থেকে দূরে মিলিয়ে যায়।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.