খোয়াব_আফসার নিজাম
খোয়াব
আফসার নিজাম
সোবেহ সাদেক। আসমানের দিকে তাকিয়ে আন্দাজ করে রহমত আলী। আজানের অল্প বাকি। এই সময়ের খোয়াব মিথ্যা হয় না। এই সময় আল্লাহ প্রথম আসমানে আইসা বান্দাগো ডাকতে থাকে। ও আমার বান্দারা তোমরা আমার কাছে চাও। আমি রহমত লইয়া বইসা আছি তোমাগো দেওনের লাইগা। তোমরা আমার কাছে চাও। এমন সময় আল্লাহর বান্দারা ঘুমায়। আবার আল্লাহর পিয়ারার বান্দা আরামের ঘুম হারাম কইরা আল্লাহর দরবারে গুনার জন্য মাফ চায়। আর জাহান্নামের আজাব থেকে পানাহ চায়। তারা সুফি মানুষ। কিন্তু রহমত আলীতো আর সুফি দরবেশ না। মসজিদে গিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। আল্লা বিল্লা করে। মানুষেরে নামাজের জন্য তাগাদা দেয়। কে শুনলো আর কে শুনলো না সেটা রহমত আলীর কাছে কোনো ব্যাপার না। দাওয়াত পৌঁছে দেওয়ার কাম সে দাওয়াত পৌঁছে দেয়। আল্লায় যদি কবুল করে এমনি মসজিদের দিকে লাইন দিবো। সেই চিন্তা তার করতে হয় না।
আজকাল অল্প টাকায় মুয়াজ্জিন থাকতে চায় না। দুনিয়ায় অনেক কাম আছে। সেইখানে কাম কাজ করলে জীবনটা সুখে শান্তিতে ভরে যায়। তাই এ পাড়াগায় মুয়াজ্জিন পেটে ভাতে থাকপার চায় না। তাই রহমত আলী নিজেই দায়িত্ব নিয়েছে মসজিদের মুয়াজ্জিনের। যদিও সে মসজিদ ঝাড়– দেয়া থেকে শুরু করে আজান দেয়ার কাজটাও করে। মাঝে মাঝে ইমাম সাহেব বাড়িতে গেলে নামাজ পড়ার কাজটাও চালিয়ে যায়।
ইমাম সাহেব এবার বড্ড বেশি দিন বাড়িতে কাটাচ্ছে। তার বউ একজোড়া পুত্র সন্তান উপহার দিছে। ইমাম সাহেবতো মেলা খুশি। তার বিবিরে তাই একটু বেশি সময় দিতাছে। রহমত আলী নিজেও বহুত খুশি। ইমাম সাহেব কিছু দিন বেশি কাটাইয়া আসুক। তার দায়িত্বটা সে নিজেই পালন করবে। কিন্তু শুক্রবার একটু সমস্যা হয়। সেদিন পাশের গ্রামের মুয়াজ্জিনকে ডেকে আনে। দুচার বয়ান তার মুখ থেকেই শুনে গ্রামের আর সকল লোক। এই খানে রহমত আলীর তেমন কোনো ভূমিকা থাকে না। সে আমপাড়া পড়া মানুষ। পুরা কুরান শরিফ তার শেষ হয় নাই। অনেক বার চেষ্টা করেছে মুখস্ত করতে। কিন্তু বুড়া বয়সে সেইটা আর হয়ে ওঠে না। চেষ্টার কমতি থাকে না তার।
ইদানিং রহমত আলী বাড়িতে তেমন থাকে না। বাড়িতে থাকার প্রয়োজনও পড়ে না। আয়েশাতো অনেক আগেই ইন্তেকাল করে চলে গেছে। বাড়িতে ছেলে, ছেলে বউ আর তিনজন নাতি নাতকুর নিয়ে চলছেতো ভালোই। ছেলের বউ এখন যেনো কেমন উদাসিন। আগের মতো তেমন যত্ন করে না। যদিও নাতনীটি দাদাজানের যত্ন করে। নাতনীটি যেনো সেই আয়েশা হয়েছে।
আয়েশার কথা তার বড্ড বেশি মনে পড়ে। যখন লাল টুকটুক শাড়ি পরিয়ে এ বাড়িতে এনেছিলো। অনেক কিছুই বুঝতো না। একদিনতো রাতের বেলা বাইরে যাবার কথা কয়ে রওনা দিছে বাপের বাড়ি চলে যাবার জন্য। রহমত আলী ঘুমিয়ে ছিলো অনেকক্ষণ পর যখন বাহির থেকে আয়েশার আশার নাম গন্ধ নেই তখন বের হয়ে দেখে দূরে একটি কি যেনো নড়ছে। দৌড়ে কাছে আসতে দেখে আয়েশা বিবি চলছে তার বাপের বাড়ি। রহমত আলীতো রাগে ফুঁসে ওঠছে
-এতো রাইতে কই যাও।
-কে তোমাগো বাড়ি আমার এতো দিন থাকতে হইবে কেন । আমগো বুঝি বাড়ি নাই। আমগো বুঝি ভাত নাই। ভাত খাওয়ার লাইগা তোমগো বাড়ি পইরা থাকতো হইবো।
কথা শুনে রহমত আলীর রাগ গেলো উড়ে।
-ও এই কথা। এই বাড়ি যে তোমগো বাড়ি না এই কথা কইলো কে?
-কে কইবো। আমি বুঝি না। এটাতো আমগো বাড়ি না।
-আরে বোকা এইটাইতো তোমার বাড়ি। আর ওইটা হইলো গিয়া তোমার বাপের বাড়ি। বিয়ার পর বাপের বাড়ি বাড়িতে থাকন যায় না।
-না যায় না! আমি বুঝি এতো দিন আছিলাম না।
-এতো দিন ছিলা। এখন আর থাকন যাইবো না।
কি সরল জীবন ছিলো। তখনতো রহমত আলীর বাপ মা বেঁচে ছিলো। তারাতো কোনো দিন ছেলের বউয়ের বিপক্ষে কোনো কথা দাড় করাই নাই। আজ কেনো সে তার ছেলের বউয়ের ব্যাপারে কথা দাড় করাবে। তাইতো সে চলে এসেছে মসজিদে। এখানে সকল অভিযোগ দায়ের করা যায়। এই অভিযোগ আল্লাহর কাছে দেয়। সে শুনে সেই ফায়সালা করে দেয়। তাই রহমত আলী আল্লাহর কাছে একটি অভিযোগ দাড় করায়। আল্লাগো তোমার কাছে আমার একটাই অভিযোগ। আমার শরীরটা আমার কথা শুনে না। এই শরীরটাকে আমার বস কইরা দাও। আমি চলমু তোমার কথায় আর আমার শরীরটা চলবো আমার কথায়। আল্লাগো এই একটা ফরিয়াদ তুমি কবুল করো।
শরীরের কথা চিন্তা করতে করতে কখন যে ঘুমে হারিয়ে গেছে রহমত আলী সেই খেয়াল নাই। মসজিদের হুজরাখানায় কেউ নাই। সে একা। ইমাম সাহেব থাকলে একটু ভালো লাগলো। হাদিসের বয়ান শুনতে শুনতে ঘুম আসা যেতো। ইমাম সাহেব চলে যায়ায় সে নিজের কথাই বেশি ভাবে। ভাবে আয়েশার কথা। যখন তারাবুনের জন্ম হলো। সেই সময়ের কথা। তারাবুন যখন পেটের ভেতর নরাচরা করতো। তার সাথে আয়েশা গল্প করতো। অনেক অনেক গল্প। এতো কথা কোথায় পেতো রহমত আলী ভেবে পেতো না। যে মেয়েটা শ্বশুরবাড়িতে প্রয়োজনের বেশি কথা বলতো না। সে যেনো কথার বক্স খুইলা বসছে। প্রায় রাতে সে বিছানায় থাকতো না। বারান্দায় বসে থাকতো। আর আকাশের তারার সাথে নিজের অনাগত সন্তানের মিল খুঁজে ফিরতো। সময় যতোই ঘনিয়ে আসলো আয়েশার গল্পও যেনো আরো বৃদ্ধি পেতে থাকলো। রহমত আলী বললো তুমি আমার সাথেতো আর থাকোই না। সারারাত বারান্দায় বইসা থাকো। একটি মুচকি হাসি দিয়ে চলে যেতো। একবার কি যেনো বলেছিলো। অনেক চেষ্টা করে মনে করতে। ও মনে পড়ছে আয়েশা বলেছিলো- তোমার কাছে থাকার চেয়েও আমার সন্তানের নরাচরা বেশি আনন্দ লাগে। রহমত আলী বুঝে ছিলো একেই বুঝি বলে মাতৃত্ব। মায়ের কাছে সন্তানের যে চির বন্ধন তা এখান থেকেই। এ জন্যই দয়াল নবীকে যখন সাহাবারা প্রশ্ন করছিলো। আল্লাহ ও রসূলের পর কার স্থান। আমার নবী বলেছিলো মায়ের। এইভাবে তিনবার মায়ের নাম বলার পর চতুর্থবার বলেছিলো বাপের কথা। নবী আরো বলেছিলো- মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত। এতো সম্মান মায়ের জাতিরে আর বুঝি কেউ দিতে পারে নাই। এই কথাটার সাথে যোগ কইরা আয়েশা আরো বলতো। বাপের সম্পত্তির তিনভাগের একভাগ, স্বামীর থেকে দেন মোহর ও স্বামীর সম্পত্তির দুই শতাংশ, ছেলের সম্পতির থেকেও ভাগ। মায়ের সম্পত্তির অর্ধেক। আবার বাপের সম্পত্তির যে তিনভাগের এক ভাগ আছে তার মধ্যেও নাকি ভাগ দিছে। যে ভাগ দেখা যায় না। নারী যখন কোনো কারণে স্বামীরে ছাইরা চইলা আহে তহন ভাইয়ের সেই ভাগের তার কিছু শরিক থাকে। এতো সম্মান দিয়ে আল্লাহ হের শুকরিয়া কইরাই মেয়ে মানুষ সন্তানের ধারনে কঠিক কাজটা আল্লাহর কাছ থিকা চাইয়া লইছে।
সময় ঘনিয়ে আসে। আয়েশা পাগলের মতো সন্তানের সাথে কথা বলতে থাকে। তারার সাথে কথা বলে। সন্তানকে মিলিয়ে নেয় যাবতীয় সৌদর্যের সাথে। অবশেষে আসলো সেই অতিকাক্ষিত দিন। প্রসব বেদনায় ছটফট করে। আয়েশার চিৎসারে যেনো আসমান জমিন একাকার হয়ে যায়। রহমত আলীর বুকটাও যেনো চৈত্রের খড়ার ফেটে যাওয়া জমিনের মতো হয়। আর মনে মনে আল্লাহর কাছে বলে আল্লাগো তারে তারাতারি খালাস করো। মুক্তি দাও।
আল্লাহ মুক্তি দিয়েছিলো। কিন্তু একেবারেই মুক্তি দিয়েছে। যেই সন্তানের সাথে মায়ের এতো কথা সেই সন্তানের সাথে কথা বলা হলো না। সপ্তপর্দার ভেতরে বন্দি হয়েই থাকলো মা সন্তানের সেই কাথাগুলো।
এরপর অনেক বছর কেটে গেছে। ছেলে বড় হয়েছে। বিয়ে করেছে। সন্তান হয়েছে। নিজের আর কিছু হলো না। অনেকেই বলেছে। রহমত আর একটা বিয়েথা করো। কেনো যেনো হয়ে ওঠলো না। বারবার মনে হয়েছে আয়েশা যেনো তার সাথেই আছে। প্রতি মুহূর্ত তাকে ছায়ার মতো অনুস্মরণ করছে। ছেলেকে মানুষ করার ফরমায়েস করছে। তার কথা মতোই যেনো জীবনটা চলছে।
কিন্তু খোয়াবটা তাকে আনমান করে তুলছে। সুবেহ সাদেকের সময় কোনো খোয়াবতো মিথ্যা হয় না। বিছানায় থেকেই রহমত আলী ছটফট করছে। কোনো প্রকারেই ঘুম আসছে না। এখনই ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এই সময় বের হলে আজানের সময় হয়ে যাবে। তার শরীর দিয়ে ঘাম ছুটছে। যেনো পাহারের গা চুয়ে ঝর্ণার ধারা প্রবাহিত হয়।
ফজরের নামাজ পড়েই রওয়া দেয় রহমত আলী। পেছন থেকে নাতনী ডাকে ও দাদা কই যাও এতো অস্থির হইয়া। নাস্তা করবা না। রহমত আলী একবার সামনের দিকে তাকায় আর একবার নাতনীকে দেখে। অবিকল আয়েশা হয়েছে। চোখের চাহনী। কথা বলার ঢং। হাঁটার ঢংও অবিকল। তফাতের মধ্যে এইটুকু। আয়েশা ছিলো একটু তামাটে। ও একটু শ্যামলা। রহমত আলী নাতনীকে একবার দেখে আবার হাঁটা দেয়। হাঁটতে হাঁটতে একেবার গ্রামের শেষ মাথায় কবরস্থানে গিয়ে পৌঁছে। দেখে অনেক মানুষের ঝটলা। নদী এখানে তার আগ্রাসন চালাচ্ছে। নদীর ভাঙ্গনে মরা মানুষের হাঁড় গোর নদীতে ভেসে যাচ্ছে। সেই তামাসাই দেখছে মানুষ। কিন্তু একটি কবর থেকে তরতাজা একটা মেয়ে মানুষের লাশ। কে এই মেয়ে মানুষ কেউ বলতে পাড়ছে না। রহমত আলী এগিয়ে যায়। কই দেখি দেখি। ভির সরিয়ে রহমত আলী লাশটার কাছে যায়। চেহরাটা দেখার সাথে সাথে জ্ঞান হারায়।
কোন মন্তব্য নেই