ভাব, শব্দ এবং উপমা ব্যাবহারে পরিমিত বোধটাই হলো আসলে শিল্পগুণ বা নান্দনিক কল্পনা_সাজজাদ হোসইন খান
ভাব, শব্দ এবং উপমা ব্যাবহারে পরিমিত বোধটাই হলো আসলে শিল্পগুণ বা নান্দনিক কল্পনা
সাজজাদ হোসইন খান
দেশের অন্যতম কীর্তিমান ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘কলম’-এর সম্পাদক কবি সাজজাদ হোসাইন খান ১৯৪৮ সনের ১৬ মে কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরবে মামাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈত্রিক নিবাস বি-বাড়িয়া জেলা সদরের ঘাটুরা গ্রামে। সফিকুল হোসেন খান ও আয়েশা খাতুন দম্পতি সন্তান সাজজাদ হোসাইন খান স্বাধীনতা উত্তর এদেশের ছড়াসাহিত্য ও শিশুসাহিত্যে রেখেছেন অনবদ্য অবদান। তার ছড়াগ্রন্থের মধ্যে রাজার কথা প্রজার কথা, নীল সবুজের হাট, স্বৈরাচারের ঐরাবত, মেঘের খামে চুমকি দানা, জোসনামাখা চাঁদ, ভাঙা চাঁদের রাঙা পাথর ও তারার গগন উল্লেখযোগ্য। তার শিশুতোষ গদ্যগ্রন্থ ‘সোনালী শাহজাদা’ একটি অন্যতম জনপ্রিয় গ্রন্থ। এছাড়াও তিনি লিখেছেন দুই কাননের পাখি, নীল সাগরে ভূতের বাড়ি ও লেংড়া জীনের বাগানবাড়ি’র মতো উল্লেখযোগ্য শিশু-কিশোর সাহিত্য। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে তার সম্পাদনায় প্রকাশ হয় সাহিত্য সংকলন ‘বিদ্রোহী বাংলা’। সাজজাদ হোসাইন খান বাংলা একাডেমী ও জাতীয় প্রেসকাবের সদস্য, বাংলা সাহিত্য পরিষদ ও ইতিহাস পরিষদের (ঢাবি) জীবন সদস্য এবং ঢাকা শিশু-কিশোর ফাউন্ডেশনের নির্বাহী সদস্য।
জনাব খান পারাবার সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৫) জাকারিয়া শাহ স্মৃতি পুরস্কার (২০০২), কিশোরকণ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার (২০০৭), লেখা প্রকাশ সাহিত্য পুরস্কার (২০০৮), রকীবুল ইসলাম ছড়াপদক (২০০৮), শব্দশীলন একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (২০১০)-এ ভূষিত হন।
ছড়ার নান্দনীকতা বা শৈল্পীকতা সম্পর্কে আলোকপাত করবেন কী?
ভাব, শব্দ এবং উপমা ব্যাবহারে পরিমিত বোধটাই হলো আসলে শিল্পগুণ বা নান্দনিক কল্পনার একটা দিক। সে ছড়াই হোক বা সৃজনশীলতার অন্য কোনো মাধ্যমই হোক। রন্ধনক্রিয়া এবং পরিবেশনার গুণে সাধরণ আনাজপাতিও সুস্বাদু-তৃপ্তিদায়ক খাবারে পরিণত হয়। মূলবিষয়টি হলো আমার ছড়াটিকে উপস্থাপনার গুণে সুন্দরের চেতনায় তুলে আনার দিকটিকেই আমরা নান্দনিকতা বা শৈল্পীকতা বলি। ছড়ায় নান্দনিকতা- ল্পৈীকতাও এর বাইরে নয়।
বাংলা কবিতায় ইউরোপিয়ান প্রভাব প্রচন্ড এর প্রভাব পড়েছে বলে কি আপনি মনে করেন? পড়লে কিভাবে পড়েছে?
ইউরোপীয়ান প্রভাব কবিতায় এতোটা প্রবল আমি মনে করি ছড়ায় তেমনভাবে প্রভাবিত নয়। কারণ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ হাজার বছর আগ থেকেই মুখে মুখে ছড়া কাটতো। তাঁরা কেউই ইউরোপীয়ান সাহিত্য পাঠ করেননি। কিন্তু সেসব ছড়া ভালো শিল্পসাধ্য ও অতুলনীয়। আমি মনে করি আমাদের বর্তমান ছড়াও সেই সত্যকেই ধারন করে আগে বাড়ছে। চর্যাগীতির কবিরা কোন্ ইউরোপীয়ান সাহিত্যের পাঠক ছিলো?
ইজম মানেই নতুনত্ব। ছড়ায় ইজম আন্দোলন নেই কেনো? তাহলে আমরা কি বলবো ছড়ায় নতুনত্ব নেই?
না ইজম অর্থই নতুনত্ব না। আসলে পরিবেশনার গুণেই পুরাতন নতুনভাবে উঠে আসে। যিনি পরিবেশন করেন তিনি নতুন। নতুনত্বটা যা দৃষ্টিগ্রাহ্য হয় সেটি হলো পরিবেশকের শক্তিমত্তা। বর্ণনার অভিনবত্ব। আন্দোলন করে সাহিত্য হয় না। আন্দোলন শব্দটাতেই একটা অনাসৃষ্টির গন্ধ লুকিয়ে আছে। এখানে অধ্যাবসায় এবং অভিনিবেশনটাই মুখ্য। আন্দোলন-ফান্দোলনে এসব ভুণ্ডুল হতে বাধ্য। আমি এক বোধের অভিনবত্ব বলাটাকেই বেশি শোভন মনে করি। ছড়ার ইতিহাস ঘাটলে অবশ্যই এর অস্তিত্ব যুগে যুগে পাওয়া যাবে।
প্রতি দশকে কবিতা গল্প নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠে, ছড়া নিয়ে উঠে না। এই না হওয়ার কারণ কি?
উঠে না তা না, তবে তুলনায় কম। সত্তুর দশকে ছড়া ঝড় তুলেছিলো বৈকি। ছড়া নিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।
সব কবি কবিতা বা কবিকে নিয়ে আলোচনা করে ছড়াকাররা ছড়াকার বা ছড়া নিয়ে আলোচনা না করার কারণ কি?
এ প্রশ্নের জবাবতো আগেই দিলাম। ছড়া লিখকদের সচেতনতার অভাবই এখানে প্রবল। এ ছাড়াতো আর কোনো কারণ দেখি না।
ছড়ায় উত্তরাধিকার ঐতিহ্য ব্যাবহার কেমন হওয়া উচিত? আপনি এর কিরূপ ব্যাবহার করেছন?
উত্তরাধিকার ঐতিহ্য বলতে কি বুঝানো হয়েছে তা ঠিক ধরতে পারলাম না। তবে এখানে স্বজাত্ববোধ এবং নিজস্ব ইতহাসকে যদি বুঝানো হয়ে থাকে তাহলে এসব ধারণক্ষমতার বাইরে ব্যাবহার উচিত না। এরকম ব্যাবহার অনেক ছড়াতেই রয়েছে।
তরুণ ছড়াকারদের সঙ্গে প্রবীণ ছড়াকারদের সম্পর্ক কেমন হওয়া দরকার বলে আপনি মনে করেন?
হৃদ্যতাপূর্ণ হওয়া বাঞ্ছনীয়।
নিব : বর্ষ-তিন সংখ্যা-ছয় মার্চ-২০০১
সাজজাদ হোসইন খান এর ছড়া
ঘোড়াদের আন্ডা
এটা দেবো ওটা দেবো
চন্দন ফোঁটা দেবো
বাঁশ দেবো শক্ত
এতটুকু, ঝরবে না রক্ত।
চাল দেবো তাল দেবো
নৌকার পাল দেবো
খাল দেবো বক্র
সাথে আরো, বিভীষণ চক্র।
উনি যান তিনি যান
আনন্দে খানখান
ঘটি ঘটি দুগ্ধ
চর্ব ও চূষ্যে, আহা কি যে মুগ্ধ!
এটা চাই ওটা চাই
ট্রানজিট-ভিটা চাই
গ্যাস চাই পাইপে
মিয়া সাব, দাও লিখে টাইপে।
লেখালেখি শেষ করে
পদতলে পেশ করে
আসে ফিরে খুশিতে
যদিওবা, ভাঙে নাক ঘুষিতে।
তিনি খান উনি খান কোক্কোলা ঠান্ডা
জনগণ হাতে পেলো ঘোড়াদের আন্ডা।
প্রার্থী হবো
কপাল ফেটে উঠবে তারা
বুকের খামে রঙিন সারা
রাতের পাখায় চন্দ্র এসে
করবে আলাপ হেসে হেসে
এমন দিনের ‘হায়ুস’ নিয়েই ভাবছি
নির্বাচনের অক্তগুলো
ওড়ায় কেমন সবুজ ধুলো
বিজয় যখন পড়বে ধরা
সূর্য দিয়ে ভরবো ঘড়া
সেই পুলকেই গরুর মতো কাঁবছি
এবার- প্রার্থী হবো ভাবছি।
পাদুকা ও পয়জার
নাসিকা ও চান্দি তাক করো
পাখওয়ালা পয়জারে ফাঁক করো।
ক্লাইভ আর মির্জারা হাঁকছে
ঐ যেনো সারমেয় ডাকছে।
সিকিমের দর্জিরা বংগে
মিরনের সার্ট দেখি অংগে।
ওরা কারা বেগানার চক্র
নিশানের রঙ করে বক্র।
বাঙাল
কাশিমবাজার কুঠি
ধরলো চুলের ঝুটি
জোসনা রোদের
খাসজমিনে
বন্ধ ছোটাছুটি।
বোয়াল মাছের গালে
শক্ত সুতার জালে
মস্ত দীঘির
বিশাল ঢেউয়ে
বমাল ধরা পুঁটি।
হস্তিনাপুর কুঠি
খামছে ধরে ঝুটি
সময় গেলে
উড়াল হাওয়ায়
টানবে কাছে টুৃটি।
ঘষেটি-মীর-শেটে
উঠান কেটে কেটে
সেই উঠানে
রোপণ করে
তিক্ত বিষের ঘুটি।
মাছ-মাংস ভাতের বদল
খাবার এখন রুটি
ভাটির দেশের বাঙালেরা
শক্ত করো মুঠি।
পচন
ভিন্ন মতের ছিন্ন তারা লুটাই ভূঁইয়ে
হাঁটছে এখন তপ্তবায়ু স্বপ্ন ছুঁইয়ে
শক্তচোখের শব্দাবলী প্রাসাদ জুড়ে
বেগানারা বুকের বিভাগ খাচ্ছে কুড়ে।
বিভীষণের হল্লা শুধু বৃক্ষসীমায়
বিদ্বজনের সিদ্ধ মগজ দাওয়ায় ঝিমায়
তক্তপোষের পোক্ত জমিন রক্তমাখা
নগরব্যাপী পুষ্পবনে দৈত্য আঁকা।
হরফগুলো ভাঙছে দেখি হেঁচকা টানে
অন্ধবৃষ পাঠশালাতে বর্তমানে
ব্রাত্যমনের প্রান্ত অভয় কাজির বচন
ওমা! সেই ঘরেও ধরছে নাকি মস্ত পচন?
কোন মন্তব্য নেই