Header Ads

Header ADS

ফুল পাখিরদের কবি আল মাহমুদ_আফসার নিজাম


ফুল পাখিরদের কবি আল মাহমুদ
আফসার নিজাম


আমি কেবল ভাবতে থাকি কেমন করে উড়বো
কেমন করে শহর ছেড়ে সবুজ গাঁয়ে ঘুরবো

কবুতরের খোপ থেকে পাায়রাটা বের হয়ে মুক্ত আকাশে যেমনি ডিগবাজি খেয়ে আনন্দে মেতে ওঠে তেমনি কবি ঘর থেকে বের হলে তার আর ঘরে ফেরা হয়ে ওঠে না। বাংলাদেশের আকাশ বাতাস আর পাখ-পাখালি সাথে সখ্য গড়ে তেলে। খুলে বসে কাব্য লেখার খাতা।

দিঘির কথায় উঠলো হেসে ফুলপাখিরা সব
কাব্য হবে কাব্য হবে জুড়লো কলরব
কি আর করি পকেট থেকে খুলে ছড়ার বই
পাখির কাছে ফুলের কাছে মনের কথা কই।
            - পাখির কাছে ফুলের কাছে



পাখির কাছে ফুলের কাছে কথা বলতে গিয়ে কবি শুনতে পান বাংলা ভাষায় কবিতা লেখা যাবে না, কথা বলা যাবে না। এই ভাষায় কথা বলতে হবে একান্ত নিজের মনে মনে। কবির কলমের নিব তখন জোসনার আলোয় জ্বলে ওঠে। নিব-এর মুখ গলে ঝরে পড়ে-

হাজার যুগের সূর্যতাপে
জ্বলে এমন লাল যে
সেই লোহিতেই লাল হয়েছে
কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে।
    - একুশের কবিতা

কবির বয়ান ঠোঁটে করে পাখিরা ছড়িয়ে দেয় শহর থেকে শহরে। রাক্ষস-খোক্ষসরা ভীষণ রেগে যায় তার কবিতা শুনে। তাঁকে ঘরছাড়া করে। ঘরছাড়া কবি রেললাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনে পৌঁছে  ‘কু-ঝিক-ঝিক’ ছন্দের তালে তালে রেলে চড়ে ঢাকায় এসে পৌঁছে।

ঢাকায় শুরু হয় কবির জীবন সংগ্রাম। পত্রিকায় কাজ করে কিন্তু তার কবিতার লাল ঘুড়িটা উড়ানোর জন্য মন আনচান করে। শহরে এসব যান্ত্রিক জীবনে সে যেনো ঘুড়ি উড়ানোর সময় করে উঠতে পারে না। তার কেবলি মন হয়-

মানুষ নামের বিজ্ঞানীরা আমায় নিয়ে খেলছে
আমার সাগর পাহাড় নদী রোলার দিয়ে বেলছে
সব বিষিয়ে দিচ্ছে মানুষ ধোঁয়ায় আকাশ অন্ধ
কলের বিষে তলিয়ে গেছে গোলাপ ফুলের গন্ধ
পক্ষী কাঁদে পুষ্প কাঁদে রসায়নের রান্না
বন্ধ করো বন্ধ করো আর পারি না আর না।
            - রসায়নের রান্না

পাখিরা থাকতে পারছে না। ফুলেরা ফুটতে পারছে না। সেই শহরে কবি কীভাবে থাকবে। কবির জন্য চাই ঢেউ ভাঙা নদী, অবারিত সবুজ মাঠ, পাখিদের সাথে কাব্য করার ফুরসত, ফুলের গন্ধ নেয়ার মৌসুম। যখন শহরে এরা থাকবে না তখন কবি মনে করেন-

ভয়ের চোটে ভাবতে থাকি শহর ভেঙে কেউ
দালান কোঠা বিছিয়ে দিয়ে তোলে খেতের ঢেউ
রাস্তাগুলো নদী এবং গলিরা সব খাল
ইলেকট্রিকের খাম্বাগুলো পাল্টে হলো তাল
মোটর গাড়ি গরুর পালে হাম্বা তুলে হাঁটে
পুলিশগুলো গুলিস্তানে নিড়ানি ঘাস কাটে।
            - ভয়ের চোটে

পুলিশ বেটা কিন্তু দারুণ ক্ষেপেছে কবির ওপর। জনগণের ওপর। তাকে নিড়ানি ঘাস কাটতে বলায়। তারা চায় মানুষের ওপর খবরদারি করতে। তারা চায় স্বাধীনভাবে কেউ চলবে না। যা বলবে তাই করতে হবে। এই কথাগুলো কবিকে জানিয়ে গেলো সেই তরুণ লাল মুরগিটা-

লাল মোরগের পাখায় ঝাপট
লাগলো খোঁয়াড়ে
উটকোমুখো শাদা বেটা
হাঁটছে দুয়ারে।

বা

ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!
ট্রাকের মুখে আগুন দিতে
মতিয়ুরকে ডাক।

কোথায় পাবে মতিয়ুরকে
ঘুমিয়ে আছে সে!
তোরাই তবে সোনামানিক
আগুন জ্বেলে দে।
    - ঊনসত্তরের ছড়া-১-২

সোনামানিকরা একটা মানচিত্র আঁকলো, কবিও ফিরে আসলো সোনার ফসলে ভরা দেশে। কতোটা দিন যুদ্ধ করে করে একেবারে হয়রান হয়ে গেছে। এবার তাঁর বিশ্রামের প্রয়োজন। তাঁর আরাম প্রয়োজন। তাঁর ইচ্ছে করে-

আমার কেবল ইচ্ছে জাগে
নদীর কাছে থাকতে
বকুল ডালে লুকিয়ে থেকে
পাখির মতো ডাকতে
... ... ... ... ... ...
আমি কেলব ভাতে থাকি
কেমন করে উড়বো
কেমন করে শহর ছেড়ে
সবুজ গাঁয়ে ঘুরবো
        - পাখির মতো

কবির এখন অনেক বয়স। কালো চুলগুলো কাশফুল হয়ে গেছে। হাঁটি হাঁটি পা পা করে পৃথিবীর এ মাথা থেকে ও মাথা হয়ে সারা পৃথিবীই তার প্রদক্ষিণ হয়ে গেলো। ঝোলা ভরে গেছে তার পুণ্যে। এখন সে স্মৃতিমন্থন করে সেই ছোট বেলার জীবন নিয়ে-

একটু ছিলো বয়স যখন ছোট্ট ছিলাম আমি
আমার কাছে খেলাই ছিলো কাজের চেয়ে দামি
উঠোন জুড়ে ফুল ফুটেছে আকাশ ভরা তারা
তারা দেশে উড়তে আমার পরান আত্মহারা।
                - হায়রে মানুষ

অথবা

গাঁয়ের শেষে বটের তলে
আমিও ছিলাম ছেলের দলে
উদোম দেহে গাছে ভিড়ে
খেলেছিলাম নদীর তীরে
আজ মনে হয় মনের ছায়া
সেই সুদূরের সজল মায়া
বুকের নিচে রোদন করে
চোখের পাতায় বৃষ্টি ঝরে।
        - ছেলেবেলা

এই যে এতোক্ষণ যে কবিকে নিয়ে আমরা গল্প করলাম তার নাম সবারই জানতে ইচ্ছে করে। কবি কী করে তাও ভাবতে ইচ্ছে করেÑ

সকাল বেলা যে পাখিটি আল্লা বলে
একলা থাকে একলা ডাকে চরাঞ্চলে
সেই পখিটির নাম ঠিকানা জানতে কি চাও
নিজকে তাবে চর হাওড়ের কবি বানাও।
            - একলা ডাকে চরাঞ্চলে

যে কবি ফুল পাখিদের ভালোবাসে, ভালোবাসে পৃথিবীর সবুজ জমিন, সেই কবি আমাদের নাম জানাবে না বলেছেন। তাঁকে চিনে নিতে হবে বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জ-শহরের কাছ থেকে, ফুলের কাছ থেকে, পাখির কাছ থেকে। আমরা কেনো তাঁকে গ্রাম, নদী-নালা ঘুরে ঘুরে খুঁজবো; কারণ তিনি বলেছেনÑ

প্রকৃতিকে বাঁচায় যারা
সেই শিশুরা
বাঁচুক জগৎ জুড়ে
তার সাথে দাও আড়ি
ফুল-পাখিদের কাঁদায় যারা
যেও না তার বাড়ি।
        - তার সাথে দাও আড়ি

বি-বাড়িয়ার মোল্লাবাড়ির মীর আবদুর রব ও রওশান আরা মীরের আদরের পাখি আল মাহমুদ পৃথিবীর মাটি স্পর্শ করে ১৯৬০ সালের ১১ জুলাই। বইপোকা ছেলেটি ইশকুলে ভর্তি হন ১৯৪২ সালে কিন্তু দাদীর কাছে আগেই জেনে নেয় অ আ, ক খ। কিন্তু বেশি দিন নিয়মের বেড়াজালে থাকেননি। আট ক্লাস পাস দিয়ে উড়াল দেন ঢাকার দিকে। তারপর পত্রিকায় চাকরি। এরপর নাদিরা বেগমকে সোনালি পাকিবন পাঠ করান। ১৯৫৬ সালে ‘কাফেলা’ সম্পাদনার দায়িত্ব পান। তারপর নদীর ছাওয়াল নদীতে ঝাঁপ দেন। চাকুরি নেন ড্রেজার ডিভিশনে। কবি আবার উঠে আসন ডাঙায়। ইত্তেফাকে চাকুরি নেন। একসময় ইত্তেফাক চোখ বন্ধ করে। তিনি চলে যান চট্টগ্রাম। তখন ১৯৬৮ সাল। সেখানেই তিন তাঁর বিখ্যাত সোনালি কাবিন কবিতাগুচ্ছ রচনা করেন এবং বাংলা একাডেমি পুরস্কারও পান। ১৯৬৯ সালে ইত্তেফাক চালু হলে ফিরে আসেন ঢাকায়। ৬৯ সালে স্বাধিকার আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করে লেখেন তাঁর বিখ্যাত ‘ঊনসত্তরের ছড়া’। ৭১-এ যুদ্ধে যান। ফিরে আসেন দেশ স্বাধীন করে। স্বাধীনতার স্বাদ না পেয়ে বাহাত্তরে সম্পাদনা করেন গণমানুষের কণ্ঠস্বর ‘গণকণ্ঠ’। মানে প্রতিবাদের কণ্ঠ। ১৯৭৪ সালে গ্রেফতার হয়ে জেলে যান। সেখানেই তিনি প্রত্যাবর্তন করেন দ্বীনের পথে। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ৭৫-এ যোগ দেন শিল্পকলা একাডেমিতে। তিনি অনেক বই লিখেন। প্রথম বই লোক লোকান্তর, তাঁর জগৎবিখ্যাত বই সোনালি কাবিন। এছাড়াও বখতিয়ারের ঘোড়া, দোয়েল ও দায়িতা, অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না, বিরামপুরের যাত্রী, উড়ালকাব্য, দ্বিতীয় ভাঙন ইত্যাদি। উপন্যাসও লিখেছন অনেক। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস কাবিলের বোন, যেভাবে বেড়ে ওঠি, আগুনের মেয়ে, ডাহুকী, উপমহাদেশ, তুষের আগুন ইত্যাদি। কিশোরদের জন্য তাঁর উপন্যাস মরু-মূষিকের উপত্যকা, মুহাম্মদ সা.। প্রবন্ধগ্রন্থ কবির আত্মবিশ্যাস, কবির কররেখা ইত্যাদি। ছাড়াও লিখেছন অনেক। তাঁর বিখ্যাত ছড়ার বই পাখির কাছে ফুলের কাছে। একটি পাখি লেজঝোলা, মোল্লাবাড়ির ছড়া ইত্যাদি গ্রন্থ।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.