Header Ads

Header ADS

নান্দনিক প্রচেষ্টার নির্যাস : তিন পুরুষ এবঙ পুত্রপ্রজন্ম_তাজ ইসলাম

 
জারি সারি পুঁথি পাঠের শুরুটাই ছিলো ‘প্রথমে বন্দনা করি আল্লাহ নবির নামে’ এর শুরুটা রীতিমতো গবেষণার বিষয়। আধুনিকতার স্পর্শেরও এর স্রোত ব্যাহত হয়নি বরং আরো উৎকর্ষতায় উত্তীর্ণ হয়েছে। স্রষ্টার গুণগানে শুরু করা প্রাচীন কাব্য-সাহিত্যে দেদার লক্ষ করা যায়। যাপিত জীবনে আধুনিকতার অবগাহনে ও চলনে বলনে আধুনিক একজন আফসার নিজাম ভুলে যাননি স্রষ্টার কথা। রীতি প্রাচীন কিন্তু বয়ানের কৌশল নান্দনিক। কবি তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তিন পুরুষ এবঙ পুত্রপ্রজন্ম’ শুরু করেছেন প্রার্থনা নামক কবিতা দিয়ে। এ কবিতায় কবি স্রষ্টাতে নিমজ্জিত হয়ে স্রষ্টাকে নিষ্ঠার সাথে স্মরণ করার দৃষ্টান্ত মূলক চরনে উল্লেখ করেন-
‘প্রার্থনা করো মনসুর হাল্লাজের মতো
চামড়া ছিলে নেয়ার পূর্বে আল্লাহ হক জিকিরে
যেভাবে মিশে গেলো পরমাত্মায়’
মানুষের প্রকাশ্য শত্রু বিতারিত শয়তান, শয়তান কর্তৃক মানুষ বিভ্রান্ত হয় তাই তিনি মানুষকে একজন সুহৃদের মতো পরামর্শ দেন-
প্রার্থনা করো মহান প্রভুর কাছে
ইবলিশের কূটচাল থেকে নিষ্কৃতির প্রত্যাশায়। (প্রার্থনা)
কবির সৃষ্টি সমূহের মাঝে এটি তার প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ। আধুনিকতা কবিকে ছুঁয়েছে আপাদমস্তক। কবিতার প্রতিটি শব্দগুচ্ছেই আধুনিকতার আলো ঠিকরে পড়ে। কবির দ্বিতীয় কবিতার বুননেও মনে হয় নকশি কাঁথার বুনন তিনি উচ্চারণ করেন-
মাননীয় প্রফেট
এবার নেমে আসুন
দেখুন আপনার উম্মত
বাতলিয়ে দিন-
ডিজিটাল সময়কে নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল
এবঙ পরমাণু শক্তির আনবিক বিন্যাসের কথা- (মাননীয় প্রফেট)
মোট তেত্রিশটি স্বল্পদৈর্ঘ কবিতা নিয়ে প্রকাশ পেয়েছে ৪৮ পৃষ্ঠার এই বইটি। একেকটি কবিতা কবির একান্ত আপন জনের মতো তাই সুচিতে সম্বোধন করেছেন সন্তানেরার মতো কবিতারা।
ব্যাক্তিগত বিষয় আশয় যে একজন গুণি শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় কতোটা শৈল্পীক রূপ ধারন করতে পারে তা অনুধাবন করা যায় ‘দাড়ি হত্যাকারী’ কবিতাটি পাঠ করে। এবঙ কুটিনাটি বিষয়কে উপজিব্য করে স্পর্ষ করা যায় আন্তর্জাতিকতা। তার চমৎকার উপমা সুলভ পঙক্তি
আহ! কি কষ্ট নিয়েই না
চলে গেলো তারা
ফিলিস্তিনিদের মতো উদ্বাস্তু হয়ে
নিজেদের জমি থেকে। (দাড়ি হত্যাকারী)
নিবেদিত কবিতা লিখেছেন কয়েকটি। প্রতিটি কবিতা হৃদয় উজার করা আবেগে আপ্লোত। একথাও সত্য আবেগকে তিনি বিসর্জন দেননি। কাব্যশর্ত সমম্পূর্ণ কাব্যগুণে হৃষ্টপুষ্ট হয়েই হাজির হয়েছে শহিদ বেলালকে নিবেদিত কবিতা ‘ক্রিস্টাল চোখ’ প্রখ্যাত কবি মতিউর রহমান মল্লিককে নিবেদিত ‘’রাত্রি জাগগরণের কাব্য’ জহুরিকে নিবেদিত কবিতা ‘’কলমের সাইকেল দৌড়’ এবঙ নজরুল দিবস স্মরণে রচিত ‘স্বরাজ ফেরিওয়ালা’ কবিতা।
তার কোনো কোনো কবিতায় আধ্যাত্মিকতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে কলমের নিপূণ কারিশমায়। ছন্দের রাজসিক তাল নুপুরের রিনিঝিনি আর আধ্যাত্মিকতা মিশ্রণপূর্ণ একটি কবিতার অংশ
তার যতো কল্পনা আবেগআকাশ
আত্মার আত্মীয় সংসারসহ
জগতের চাওয়া-পাওয়া মিটে গেছে রাতে
সব কিছু ফেলে গেছে- গেছে খালি হাতে। (গতকালও ছিলো শে)
‘কারামতি স্কার্ফের নিদ্রাহীন নার্সিং চোখ’ ‘এম্রয়ডারি সন্ধায়’ ‘জমির জায়নামাজ এখন’ ‘চোখের ফারাক্কা’ ‘জিকিরে জিকিরে ভাসে তার ইশকের বয়ান’ এমন উর্বর উপমা সিক্ত কবিতার পঙক্তি দেখা পাওয়া যায় কবি আফসার নিজামের প্রায় প্রতিটি কবিতাতেই তাই খুব বেশি চমকিত হইনি যখন পাঠ করি ‘প্রিয় অসুন্দর তোমাকে ভেঙে দেবো আয়নার মতো।
সহজ সরল সাবলীল ভাষায় কী অসাধারন রচনা আর এমন সব কথার মুক্তো ‘তিন পুরুষ এবঙ পুত্রপ্রজন্মের কবির লেখাতে থাকাই যেনো স্বভাবিক।
ইবাদতে আমরা প্রয়োজনীয় অনুসঙ্গ ভুলে অতিঞ্জিজত বিষয়ে মনোযোগী হই বেশি। ঘুরপাক খাই প্রচলিত রেওয়াজের চক্করে। কবি এ ব্যাপারে শ্লেষের সাথে উল্লেখ করেন-
গত শবেবরাতে তিনি আসবেন বলে
একশ বত্রিশ লাইন মোনাজাত
এবঙ এক বোতল চোখের পানি নিয়ে ছিলেন। (শবেবরাত)
কবির অনুল্লেখিত ইঙ্গিত তিনি এতো লম্বা মোনাজাত যদি না করতেন তবে এই মহিমান্মিত রজনীতে আমরা আরো বেশি সেজদায়, তেলাওয়াতে, জিকিরে স্রষ্টার সানিধ্য লাভের চেষ্টা করতে পারতাম। আফসার নিজামের কবিতায় প্রেম এসেছে পবিত্র হয়ে নগ্নতা বর্জিত তাই তার ‘প্রজাপতি চুমুতে কোল জুড়ে নেমে আসে পবিত্র শিশু’ এই পবিত্রতা রক্ষার জন্য প্রয়োজন পারিবারিক বন্ধন।
রূপমুগ্ধ দৃষ্টির প্রবাহে জেগে উঠলে প্রকৃতি
আমি আমুগ্ধ পান করি রেহনুবা শারাব।  (রেহনুবা শারাব)
প্রিয়তমাকে নিয়ে কবিতায় এভাবেই কবি উৎপ্রেক্ষার চিত্রকল্প আঁকেন এবঙ ঘর মুখি হন। এই বইয়ের অন্যতম কবিতার নাম ‘তিন পুরুষ এবঙ পুত্রপ্রজন্ম’ যাতে বর্ণিত হয়েছে কবির ঐতিহাসিক অভিজজ্ঞতা। এখানে তার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বলেছেন হিটলারের বিশ্ব শাসনের খায়েশের কথা অতঃপর বিশ্ব যুদ্ধের, বিশ্বজগতের বিধস্ততার কথা। তারপর বর্ণনা করেছন নিজের পরিচিত ইতিহাস উপমহাদেশের ইতিহাস, বাঁশের কেল্লার দ্রোহ, বৃটিশ বিদায় পরবর্তি নতুন দেশ। সে দেশে ভাষার জন্য আন্দোলনের ইতিহাস এই সবের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত সময় তাকে করে তুলে ক্রমান্বয়ে পরিপক্ক রূপে। তৃতীয় পুরুষের চোখে তিনি দেখেছেন মুক্তিযুদ্ধ ও এরপরবর্তী ইতিহাস এবঙ সাম্রাজ্যবাদের ছড়ি ঘুরানো, মধ্যপ্রাচ্যের ল-ভ- অবস্থা এই বহমান ঘঠনাবলিই তাকে সহায়তা করে অভিজ্ঞ হতে। আর এই অভিজ্ঞতা অর্জিত জ্ঞান পৌঁছে দিতে প্রয়োজনবোধ করেন তার প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। তিনি লেখেন-
আমার এ উপদেশ পুত্র এবঙ পুত্রের পুত্র
এবঙ অনাগত পুত্রপ্রজন্মের জন্য।
.. .. .. .. .. .. .. .. ..
পূর্বপুরুষের অভিজ্ঞতার চোখ ছুঁয়ে দেখেছি
ইতিহাসের পা-ুলিপি
.. .. .. .. .. .. .. .. ..
আর এতোসব অভিজ্ঞতার ভেতরে
আমি ছুঁয়েছি বাংলাদেশ। (তিনপুরুষ এবঙ পুত্রপ্রজন্ম)
এই বইয়ের সবচেয়ে দীর্ঘতম কবিতার নাম যুদ্ধ। যুদ্ধ কবিতায় কবি যুদ্ধের বিস্তর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দিয়েছন। কি যুদ্ধ? কেনো যুদ্ধ? কার যুদ্ধ? কিসের যুদ্ধ এই সব প্রশ্নের সমাধান মিলবে কবির এ কবিতাটি পাঠে। তবে সব যুদ্ধের সমাপ্তি রেখা এক বিন্দুতে কবি মিলাতে চেষ্টা করেছেন।
সন্ধি নয় যুদ্ধ, যুদ্ধের জন্য যুদ্ধ? শান্তির জন্য যুদ্ধ
কৃষক যে বীজ বুনে দিলো তার নাম যুদ্ধ
বীজ ফেটে যে অঙ্কুরোদগম হলো তার নাম যুদ্ধ। (যুদ্ধ)
ঢাকাকে বাংলা কবিতার রাজধানী হিসাবে আখ্যায়িত করে বোদ্ধা মহল। সেই ঢাকায় কবিতার জমিকে উর্বর রাখতে নেত্রিত্বের জায়গা থেকে লড়ে যাচ্ছেন যে কজন তরুণ নিঃসন্দেহে আফসার নিজাম তাদের অন্যতম একজন। সাংস্কৃতিক মহলে তার পরিচিতি যথেষ্ট। দেশের শীর্ষস্থনীয় শিল্প মাধ্যমে তার উপস্থিতি ইর্ষনীয়। কবিতার বই তার বহু আগেই কাম্য ছিলো। বিলম্বের অবসানে এগিয়ে এসেছে আত্মপ্রকাশন। আফসার নিজামের প্রথম কাব্যসন্তান ‘তিন পুরুষ এবঙ পুত্রপ্রজন্ম’ মেধার উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত, তার প্রতিটি কবিতায় আধুনিকতার উপস্থিতি লক্ষনীয়। তবে তথা কথিত রসম, রেওয়াজ, ইজম আর জটিলতা মুক্ত। ভাষা সহজ সাবলীল কিন্তু প্রখর চিন্তার খোরাকে ভরপুর এবঙ উপমা উৎপ্রেক্ষার আকর্ষনে পাঠক মোহিত হন সহজেই। কবি আফসার নিজাম কবিতার জন্য নিবেদিত প্রাণ এবং নিজের প্রতি অত্যান্ত আস্থাশীল তার ভাষায়
আমার আগে কেউ কবিতার জন্য প্রাণদান করেনি
কেউ একটি নতুন গাছ রোপণ করে ঢালেনি পানি
মায়া মমতা প্রেম ভালোবাসা দিয়ে
করে তোলেনি সুঠাম দেহের অধিকারী। (আমার আগে কেউ না)
আত্মপ্রকাশন এই বইটি প্রকাশ করে সাহিত্য সুহৃদের ভূমিকা পালন করেছেন। প্রচ্ছদ এঁকেছেন কবি নিজে। প্রকাশ কাল ২০১৪ এপ্রশে গ্রন্থমেলা, বিনিময় আশি টাকা। বইটি কবিতা প্রেমিকদের কাব্য পিপাসা মিটাবে বলেই বেশি।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.