Header Ads

Header ADS

রেশমী শব্দের বুননশিল্পী_আফসার নিজাম


রেশমী শব্দের বুননশিল্পী
আফসার নিজাম


কবিতার ভেতর শব্দের খেলা করা, শব্দকে নিয়ে নতুন ইমেজ তৈরি করা, একজন শক্তিমান কবিপুরুষের কাব্যপ্রতিভার বহিঃপ্রকাশ। একটি ভাষার ভেতর নানা কিসিমের শব্দের উপস্থিতি আমরা লক্ষ্য করি। কিন্তু কোন শব্দটি প্রেয়সী কবিতার জন্য মানানসই তা নির্বচনা করে কবি। শব্দ এখানে প্রেয়সী কবিতাকে সাজানোর অলংকার, কসমেটিক, মেকাপ। শব্দ আবার পোশক, পোশাকের রঙ, চুলের খোঁপা বা বিনুনীও বলতে পারি। আল মাহমুদ যেমন বলেন, ‘কবিতা আমার মক্তবের মেয়ে চুল খোলা আয়েশা আক্তার’। আর কবি মসুর আজিজ বলেন,
রাতের নামাজিকে ঘিরে রাখে ফেরেশতাকুল
কবিরাও রাত ভর জেগে থাকে
বেড়ে চলে শব্দরূপ সৌন্দর্যের বুনন।
          -সৌন্দর্যের বুনন

পয়ারের পাড় ভেঙে গদ্যের গতি
ব্যঞ্জনা এনে দেয় দ্রোহের আগুন
প্রকৃতির বেনারসি পলাশ ফাগুন
কান্না হাসির গান টেনে দেয় যতি।
শব্দের ফুলগুলো কবিতার মালা
প্রশান্তি খেলা করে দূর করে জ্বালা।
        -শব্দের বেনারসি




কবিতার ভেতর যে শব্দরূপ সৌন্দর্য তার অন্বেশায় কবিকে ডুবে দিতে দেখি মেঘনা নদীতে, প্রবহামান মেঘনায় তীরে বা মেঘনার বুকে জেগে ওঠা স্থনাচরে। মেঘনা বিধৌত চাঁদপুরে জন্ম কবি মনসুর আজিজের। সেখানে কিশোর জীবন অতিবাহীত করার কারণে আঞ্চলিক শব্দকে তার কবিতাপ্রেয়সিকে পরাতে দেখি বারংবার। কবি জসীম উদদীনকে দেখি লোকজ উপদান সংগ্রহ করে কবিতাকে সাজতে আবার কবি আল মাহমুদকে দেখি লোকজ শব্দের ব্যাবহার করে আধুনিক মনন তৈরি করতে। কবি মসসুর আজিজ সে পথ দিয়ে না হেঁটে অন্যপথে মঞ্জিলে পৌঁছার চেষ্টা করছেন। তাঁকে লোকজ শব্দ ব্যবহার না করে আঞ্চলিক শব্দকে ব্যবহার করতে দেখি। আমি এখানে লোকজ শব্দ আর আঞ্চলিক শব্দ এই দুয়ে বিভক্ত করেছি।

লোকজ শব্দ: লোকজ শব্দ হলো বাংলাভাষাভাষি জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষা। বাংলা প্রমিত রূপ আর লোকরূপের মধ্যে বিস্তর ফারাগ লক্ষ্য করা যায়। বাংলা প্রমিত ভাষার চেয়ে লোক ভাষার আধিক্য লক্ষ্য করার মতো। বাংলা ভাষা উপভাষা আঞ্চলিক ভাষা সম্মিলিত রূপ হলো লোকভাষা। আর এই ভাষার শব্দরাজীকে লোকজ শব্দ বলা হয়। যেমন, নোয়াখালী, সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশাল, মোমেনশাহী, রাজশাহী, বগুড়া এবং পশ্চিম বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা সমূহের ভাষা নিয়েই বৃহত্তর বাংলা লোকভাষার অবস্থান।

আঞ্চলিক শব্দ: আঞ্চলিক ভাষা হলো একটি মাত্র অঞ্চলের ভাষারূপ। লোকভাষা যেমন বাংলার প্রতিটি অঞ্চলের ভাষার সমন্বিতরূপ। তেমনি আঞ্চলিক ভাষা একটি অঞ্চলের মানুষদের ভাষার সমন্বিতরূপ। যেমন আমরা ধরতে পারি কবি মনসুর আজিজের অঞ্চল চাঁদপুর। কেবল মাত্র এই অঞ্চলের ভাষাই হলো একটি আঞ্চলিক ভাষা। আর এই ভাষার শব্দরাজী হলো আঞ্চিলক শব্দমালা। এই আঞ্চলিক ভাষার কোনো লেখ্যরূপ পরিলক্ষিত হয় না। শুধুমাত্র এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলের উচ্চারণগত পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।

এতোটা কাসুন্দী আটলাম এ জন্য যে কবি মনসুর আজিজ আধুনিক মননে, কবিতায় আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহারের প্রাঙ্গমতার কারণে। যে কোনো মানুষ অন্য একজন মানুষ থেকে যেমন আলাদা ঠিক তেমনি তার মননও আলদা। এই মননকে বুঝতে হলে তাকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হয়। অনেক সময় কোনো কোনো সৃজনশীলদের মধ্যে এই প্রবণতা এতোটাই প্রকট যে তাকে মোটা দাগেই আলাদা করা যায়। যেমন আমরা আধুনিক সময়ের সৃজশীল কাব্যপ্রতিভা মাইকেল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জসীম উদদীন, জীবনান্দ, ফররুখ, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদকে আলাদা করতে পারি। এখানে তাদের কাব্য প্রতিভা, ভাষার ব্যবহার, প্রয়োগে নিপুননতা, বুননের কৌশল, শব্দ প্রয়োগের মুন্সিয়ানা বা নতুন নতুন শব্দ উপস্থাপনের প্রতিভার কারণেই আলাদা করতে পারি। কবি মনসুর আজিজের বৈশিষ্ট্য হলো তার নতুন শব্দ উপস্থাপনের মনন। তিনি নিজেকে আলাদ করতে একটি অঞ্চলের ভাষাকে বা শব্দরাজীকে বেছে নিয়েছেন। যদিও তিনি কবি আল মামুদের মতো কৌশল বেছে নিয়েছেন। আল মাহমুদ যেমন আধুনিক কবিতার ভেতর লোকজ শব্দকে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন ঠিক তেমনি মনসুর আজিজ সমসাময়ীক কবিতা বুনুনেন মধ্যে আঞ্চলিক শব্দকে জুড়ে দিয়েছেন। এখানে কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে:

‘রূপালি মাছের ঘাই দেখে জাগে জেলেদের মনে আশা
ধানের ছড়ায় কৃষকের হাসি বুকভরা ভালোবাাসা
মেঘের ভেলায় ঈগলের ডানা দোল খায় মিঠে রোদে
স্বপ্নের বিভা আলোকিত হয় জীবনের নানা বোধে।’
- ...................

‘মধুর মিলন’ লেখা জোড়া পাখি ফুলের রুমাল
মুলিবাঁশ ফাঁক করে লাজুক নজর প্রেমিকার
চাতক হৃদয় মন প্রতিক্ষণে বিলি কাটে আল
সোনামুখি সুই গাঁথে লাল সুতা অজানা কথার
পাখি দুটো গান গায় অবেলায় করুণ ব্যথার।
....................................................
তবুও নতুন ফ্রেমে বুনে যাই ‘ভুলো না আমায়’
স্মৃতিগুলো সুতো হয়ে প্রতিদিন হাঁটে ক্যানভাসে
জোড়াপাখি কেঁদে কেঁদে শোকেরই কাসিদা শোনায়।
        -জোড়াপাখি ফুলের রুমাল

তোমার আমার কতোদিন বলো হয়নি যে কথা বলা
দেখিনি তো আর তোমার দুয়ারে আঁধারের ছলাকলা
প্রীতির নদীও শুকিয়েছে বলে খেয়ানাও আছে তীরে
প্রতীক্ষা করেছি ভরাবর্ষার, দেখবে এ বুক চিরে?
    -একবার এসো দুকূল ছাপিয়ে

এশিয়ার মৃত্তিকা পুড়ে চলে যায়
আমেরিকার কামারশালায়
কালো কয়লা হয়ে যায় লাল টকটকে
হাপড়ের টানের গতি বেড়ে যায়।
দগদগে লোহার ছ্যাঁকা পড়ে মধ্যপ্রাচ্যে
মাটি কেঁপে ওঠে
আকাশ কেঁপে ওঠে
কেঁপে ওঠে জ্বলন্ত ইরাক।
 -বোধের অনবরত নক্ষত্র

পোয়াতি মাঠে সোনালী ধান পাকে
মাঠ জুড়ে মাটিরা হাসে
কৃষকের হাসিও শান দেয়া কাচির মতোন।
-নিরন্ন মানুষের মুখে নবজাতকের হাসি

শব্দে মধ্যে প্রথমত দুটি বিভাজনে লক্ষ করা যায়। একটি কোলম শব্দ অন্যটি কঠিন শব্দ। কোমল শব্দ মুক্তাক্ষরের আধিক্য আর কঠিশ শব্দগুলোতে যুক্তাক্ষরের আধিক্য লক্ষ্যনিয়। আঞ্চলিক শব্দে কোমলরূপটিই পরিলক্ষিত হয়। কবি মনসুর আজিজ কঠিন শব্দকে পাশকাটিয়ে কোমল শব্দরাজীকে ব্যবহার করতে দেখি। তার জন্মভূমি চাঁদপুরের যে শব্দরাজী এর আগে কেউ এতোটা আন্তরিকতা নিয়ে তুলে এনেছেন তেমন কোনো প্রমাণ আমাদের কাছে নেই। তিনিই সম্ভবত প্রথম যে তার আঞ্চলিক শব্দনিয়ে সমসাময়ীক কবিতা বুনন করেছেন। আমি কবিকে বলেছি রেশমি শব্দের বুননশিল্পী। রেশমি শব্দের মধ্যে একটি কোমলতা, মশ্রিনতা আছে। মনসুর আজিজ সেই সব আঞ্চলিক শব্দগুলোকেই নির্বাচন করেন যে শব্দগুলো সমসায়ীক মানুষের মাঝে কমিনিকেট করে। যে শব্দগুলো তার তমদ্দুনের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে সেই শব্দগুলোকে তিনি তুলে আনেন। যখন তার তমুদ্দন শব্দগুলোকে গ্রহণ কর তখনই তাকে সার্থ প্রয়োগ বলে আমরা ধরে নেই। কবি মসুর আজিজের সার্থকতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে আঞ্চলিক শব্দের জাতীয় হওয়ার স্বপ্ন। কবি মসুর আজিজ সার্থক হোক, সার্থক হোক আঞ্চলিক শব্দের জাতীয় হওয়ার স্বাপ্ন।


কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.