স্মৃতির আয়নায় শাহাবুদ্দীন আহমদ_আফসার নিজাম
স্মৃতির আয়নায় শাহাবুদ্দীন আহমদ
আফসার নিজাম
-আব্বা আমি নজরুলকে দেখেছি।
আব্বা তো অবাক
-কয় কি ছেলে! নজরুল কি আজ ইনতেকাল করেছে? সে তো তোর জন্মের আগেই ইন্তেকাল করেছে।
-আব্বা আমি মিথ্যা বলছি না। আমি সত্যি সত্যি-ই দেখেছি। কাশফুলের মতো ধবধবে শাদা চুল, লম্বা লম্বা ঘার পর্যন্ত। বড় বড় চোখ। ইয়া বডি। শাদা সার্ট, শাদা প্যান্ট পরা এবঙ জুতা জোড়াও শাদা। কী তাঁর কণ্ঠ। যেনো খোদার আসন আরস ছেদিয়া ওঠে, আর কি অট্টহাসি আর কি সুন্দর মজবুত শব্দ উচ্চারণ। গানও গায় চমৎকার।
এই বর্ণনা দেয়ার পর আব্বা যেনো দম মেরে গেলেন। তারপর সেঁ বললেন
-নজরুলের ইন্তেকালে সময় আমি ছিলাম। ঢাকা ভার্সিটির এলাকায় মাইনসের মাথা যেনো মাইসে খায়। সেই সময় নজরুলের মতো একজনরে দেখছিলাম নজরুলের ভাই হইবো।
আমি বললাম
-না আব্বা, নজরুলের ভাই না। তিনি হলেন নজরুল গবেষক শাহাবুদ্দীন আহমদ।
এতক্ষণ আব্বার সাথে যে কথাগুলো আমার হলো তা একমাত্র শাহাবুদ্দীন আহমদকে নিয়েই। নাঈম মাহমুদ তখন বিপরীত উচ্চারণের পরিচালক। আর আমি সেই বিপরীতের সর্ব কনিষ্ঠ কর্মী। গল্প লিখতাম। আমার সমসাময়ীক আরো দু’জন ছিলো। তারা হলো মরহুম কবি রকীবুল ইসলাম ও ছড়াকার ফয়েজ রেজা। আমরা ছিলাম সবার আদরের ধন। বিশেষ করে আমি। আমাদের এক প্রোগ্রামে সভাপতিত্ব করার জন্য শাহাবুদ্দীন আহমদ এবঙ প্রধান অতিথি হিসেবে কবি আল মাহমুদ এসেছিলেন। সেদিন-ই আমি শাহাবুদ্দীন ভাইকে দেখি। তাঁকে দেখে তো আমি চোখ ফিরাতে পারি না। এযে সাক্ষাৎ কাজী নজরুল ইসলাম। কেনো যেনো সেদিন আমার কাছে আল মাহমুদ নয় ডামী নজরুলকেই বেশি ভালো লেগেছিলো। আর তাঁকে দেখে দেখেই পুরো প্রোগ্রাম শেষ করে ছিলাম। তারপর বাসায় এসে আব্বার কাছে সেই কাহিনী বলা।
আমার আব্বা শিক্ষিত কোন লোক ছিলেন না। ছিলেন দিনমজুর। তারপরও পারিবারিক একটি লাইব্রেরি ছিলো। আমার দাদা মহুম কফিল উদ্দিন মোল্লার। সেঁ ছিলেন বৃটিশ নৌবাহিনীতে। রিটায়ার্ড হওয়ার পর তাবলীগ জামায়াত করতেন এবং তাবলীগ জামায়াতের টঙ্গী মসজিদে ইমামতি করতেন। তাঁর সেই ছোট্ট লাইব্রেরিতে যে ক’টি বই ছিলো তার মধ্যে নজরুলের সঞ্চয়ীতাও ছিলো। আব্বা সঞ্চয়ীতার যেসব কবিতা পড়তেন তা আমাদের মুখস্ত বলতেন। আর সেই কবিতা যখন শাহাবুদ্দীন আহমদের কাছে শুনলাম তখন মনে হলো এ কবিতা তো কবিতা নয় মধুর হাড়ি। তিনি যখন বক্তৃতা করতেন তখন কথায় কথায় কবিতা আবৃত্তি করতেন, গান পরিবেশন, বিশেষ করে নজরুলের মুসলিম মানকেই তুলে ধরার প্রবণতাই তাঁর মধ্যে বেশি দেখা গেছে আর তিনি যখন আবৃত্তি করেন
নাই তাজ!
তাই লাজ?
ওরে মুসলিম খজ্জুর-শির্ষে তোরা সাজ
করে তসলিম হর কুর্নিশে শোর আওয়াজ
বা যখন গান ধরেণ
দূর আরবের স্বপন দেখি
বাংলাদেশের কুঠির হতে
তখন দুনিয়ার তাবদ চিন্তা থেকে মন স্থির হয়ে যায় তাঁর কথার জাদুতে। তাঁর গানের জাদুতে।
এই যে এতক্ষণ যা বললাম, তা ছিলো শাহাবুদ্দীন আহমদের সাথে আমার প্রথম মুলাকাত। দ্বিতীয়বার আমাদের মুলাকাত হয় কাজী নজরুল ইসলামের জন্মশতবার্ষিকীর সম্মেলনে। সেখানে আর এক মজার ঘটনা ঘটে যায়। তখন আবার আমি আবিস্কার করি তরুণ এক নজরুলকে। তাঁর নাম জাকির আবু জাফর। এযেন মহাবিস্ময়। আমাদের দেশে যেনো নজরুলে কোন ঘাটতি পরবে না। যুবক নজরুল, প্রবীণ নজরুল। তখন মনের ভেতর একটা সাধ জেগেছিলো নজরুলকে নিয়ে যদি একটা ছবি বানাতে পারতাম। তাহলে আমি যুবক ও প্রবীণ দুই নজরুল-ই কি অনায়াসে না পেয়ে যেতাম। সে ছবি করা আজ স্বপ্ন হয়ে গেলো।
এবার আমি বলবো শাহাবুদ্দীন আহমদ সম্পর্কে আমার শেষ কথা। কবি মতিউর রহমান মল্লিক ভাই আমাকে ডেকে নিয়ে যখন প্রত্যাশা প্রাঙ্গণে কাজ করার সুযোগ করে দিলেন। তখন তিনি শুধু কাজ করার সুযোগ তৈরি-ই করলেন না। ডানপন্থি সকল কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-বুদ্ধীজীবিদের সাথেও মিশার সুযোগ তৈরি করে দিলেন। মল্লিক ভাই কেনো যেনো আমাকে জাকির ভাইয়ের সাথে কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধীজীদের সাথে কাজ করার জন্য উন্মুক্ত করলেন। এই সুযোগে আমার শাহাবুদ্দীন আহমদ ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক গাঢ় থেকে থেকে গাঢ়তর হয়। প্রত্যাশা প্রাঙ্গণের প্রায় প্রতিটি প্রোগ্রামেই কবি আল মাহমুদ ও শাহাবুদ্দীন আহমদ নির্ধারিত অতিথি থাকতেন। বিশেষ করে শাহাবুদ্দীন ভাই সেমিনারগুলোতে প্রবন্ধ পাঠ করতেন। তাই সেই প্রবন্ধ তৈরি থেকে কম্পোজ এবঙ মেহমানদের পৌঁছানোর দায়িত্ব আমার থাকতো। আর এতোবার আসা যাওয়ার মধ্যেই শাহাবুদ্দীন ভাইয়ের পরিবারের সাথেও আমার একটা সম্পর্ক স্থাপন হয়ে যায়। শাহাবুদ্দীন ভাইয়ের স্ত্রী তার বাসায় গেলে বলতেন
-এসো ভাই এসো। বসো
তারপর সকল সুখ এবঙ দুখের গল্প বলে যেতেন। বিশেষ করে তাঁর যুবক সন্তানের মৃত্যু বিষয়ক। শাহাবুদ্দীন ভাই প্রথমে কিছু বলতেন না। তিনি তাঁর স্ত্রীর দু:খও শেয়ার করতেন। আর বলতেন,
-সন্তান হারোনো বেদনা ভুলা যায় না। আর সেই সন্তান যদি যুবক হয়? তুমি কিছু মনে করো ভাই।
না আমি কিছু মনে করতাম না। আমিও চাইতাম তাঁর কথা বলে সেঁ হালকা হোক। শুধু ভাবি নয় শাহাবুদ্দীন ভাইও হালকা হতো তা আমি বেশ বুঝতাম।
শেষ মুহূর্তে এসে শাহাবুদ্দীন ভাই বেশ অর্থকষ্টে পড়ে যান। মল্লিক ভাইকে প্রায় ফোন করতেন। আমি বুঝতাম কি জন্য ফোন করেছেন। মল্লিক ভাইকে ফোন দিতে-ই মল্লিক ভাই বলতেন
-নিজাম তোমাকে একটু শাহাবুদ্দীন ভাইয়ের বাসায় যেতে হবে।
আমি অফিস থেকে একটা খাম নিয়ে সোজা শাহাবুদ্দীন ভাইয়ের বাসা চলে যেতাম। তারপর চা-নাস্তা, আড্ডা এবঙ আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বাড়ি ফেরা। এরপর একদিন হার্টস্ট্রক। আইসিইউতে দীর্ঘ ৩৬দিন অতিবাহিত করে গত ১৬ মে চলে গেলেন মহান আল্লাহর দরবারে। আমরা তাঁর রূহের মাগফেরাত কামনা করি।
শাহাবুদ্দীন আহমদের জীবন ছিলো বৈচিত্রমতয় এবঙ সাবলিল। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বশিরহাট জেলায় আরশুল্লাহ গ্রামে ১৯৩৬ সালের ২১ মার্চ এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম আফিল উদ্দিন আহমদ, মাতা মরহুমা মোমেনা খাতুন। তিনি ১৯৫২ সালে পশ্চিমবঙ্গে মেট্ট্রিক পাশ করেন এবঙ ১৯৫০ সালে বাপ-মায়ের সঙ্গে বাংলাদেশে চলে আসেন এবঙ খুলনার বিএল কলেজে ভর্তি হন। ১৯৬৩ সালে নুরজাহান বেগমকে বিয়ে করেন তার ঘরে জ্নম নেয় ২পুত্র ও ২ কন্যা। এদের মধ্যে বড় ছেলে ইন্তেকাল করেন যুবক বয়সেই। তাঁর বৈচিত্রময় জীবনে প্রচুর কাজ করেছেন। ১৯৬০ সালে ‘লেখক সংঘ পত্রিকা’র সহকারী সম্পাদক হন। ১৯৬২ সালে ‘পরিক্রম’-এর সহকারী সম্পাদক হন। ১৯৬৩ সালে লেখ সংঘের সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ সালে সাহিত্য পত্রিকা ‘নাগরিক;-এর সম্পাদনা করেন। ১৯৭৫-৭৭ ‘মুক্তধারা’ প্রকাশনার সঙ্গে খন্ডকালীন সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৭৪ সালে ঢাবি সাহিত্য পত্রিকার তত্ত্বাবধায়ক হন। ১৯৮২ সালে ইসলমীক ফাউন্ডেশনের প্রকাশনা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ‘অগ্রপথিক’-এর নির্বাহী সম্পাদক হন। এবং সব শেষে তিনি দৈনিক ‘আল মুজাদ্দেদ’ পত্রিকার সম্পাদনা করেন।
তিনি বহু বই প্রকাশ রচনা করেন। যেমন শব্দ-ধানুকী নজরুল ইসলাম, সাহিত্য-চিন্তা, নজরুল সাহিত্য বিচার, ইসলাম ও নজরুল ইসলাম, নজরুল সাহিত্য দর্শন, দ্রষ্টার চোখে স্রষ্টা, কবি ফররুখ তাঁর মানস ও মনীষা, বহুরূপে নজরুল, লক্ষ বছর ঝর্ণায় ডুবে রস পায়নাকো নূড়ি। চর্তুদশ শতাব্দীর বাংলা কবিতা ইত্যাদি।
তিনি বিভিন্ন পুরস্কার পান সেগুলো হলো, ফররুখ স্মৃতি পুরস্কার-চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ সাহিত্য সংস্কৃতি পুরস্কার, দুবাই ইংলিশ স্কুল প্রদত্ত সংসদ পুরস্কার, জাতীয় সাংস্কৃতিক পরিষদ পুরস্কার ও বিভিন্ন পুরস্কার পান।
কোন মন্তব্য নেই