Header Ads

Header ADS

কবি আল মাহমুদের একটি লেখার জন্মকথা_আফসার নিজাম


কবি আল মাহমুদের একটি লেখার জন্মকথা
আফসার নিজাম

পহেলা কথা
একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার আমাকে ফোন করলো- নিজাম ভাই আমরাতো সিংগাপুরে পরবাসী সংগঠন। আমরা নিজেরা যে রিয়েলেস্টড কোম্পানি করেছি তার একটি সুভেনির করবো। আমাকে একটু সাহায্য করবেন। আমরা বাংলাদেশের প্রধান কবিদের কবিতা ছাপাতে চাই আমাদের এই সুভেনিরে। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম কার কার লেখা নিবেন? তিনি বললেন- সবার কবিতাই ছাপাতে চাই। বিশেষ করে প্রধান কবিদের কবিতা। আমি তখন কবি আল মাহমুদ, আসাদ চৌধুরী, আল মুজাহিদী প্রমুখদের নাম বললাম। তিনি আমাকে দায়িত্ব দিলেন আমি যাতে কবি আল মাহমুদের থেকে একটি লেখা সংগ্রহ করে দেই। আমি বিনা কাজে ব্যস্ত থাকি বিধায় সব সময় কথা রাখতে পারি না। সেই মোতাবেক তাদেরও কথা রাখতে পারলাম না কিন্তু তারা নাসেরা বান্দা। প্রায় প্রতিদিনই ফোন করতে থাকে লেখাটি সংগ্রহ করার জন্য। তাদের ফোনে অতিষ্ট হয়ে অবশেষে উদ্যোগি হলাম কবিতা সংগ্রহ করার।

দোসরা কথা
কবিতা সংগ্রহের জন্য খবর নিতে গিয়ে জানতে পারলাম আল মাহমুদ যে বাসায় থাকতেন সে বাসা থেকে অন্যবাসায় উঠেছেন। কিন্তু ঠিকানা জানা নেই। আমি আমার বন্ধু কবি রেদওয়ানুল হককে দায়িত্ব দিলাম সে যেনো আল মাহমুদ এর বাসার ঠিকানা সংগ্রহ করে। রেদওয়ান যথারীতি ঠিকানা সংগ্রহ করলো। আমি চলে গেলাম রেদওয়ানের ফুলকুঁড়ি পত্রিকার অফিসে। সেখানে রেদওয়ান নাস্তার আয়োজন করলো। নাস্তা খেয়ে মাগরিবের সালাত আদায় করে রওয়ানা দিলাম। কিন্তু রেদওয়ানকে আল মাহমুদের বাসার যে মৌখিক ঠিকানা ও লোকেশান দিয়েছে তাতো খোঁজে পেলাম না। আমরা মগবাজারে পথ ধরে বিকারুন্নেছার কাছে চলে গেলাম। কিন্তু খুঁজে পেলাম না। অবশেষে আবার ফোন নিশ্চিত হলাম। এটা মগবাজারে ওয়ারলেসের একেবারেই সাথে। আমাদের এই খোঁজা খোঁজি একেবারেই পণ্ডশ্রমে পর্যবসিত হলো না। আমরা আল মাহমুদের বাসয় গেলাম। তিনি অতন্ত জয়িফ হয়ে গেছে। কানেও অতন্ত কম শুনতে পান। অনেকভাবে বুঝালাম একটি কবিতা প্রয়োজন। প্রধমে প্রায় না-ই করে দিচ্ছিলেন। পরে বললেন নিজাম তুমি অনেক দিন পর এসেছো তোমাকে তো আর খালি হাতে ফেরাতে পারি না। তবে আজকে আমি দেবো না। কারণ আমার মাথায় কবিতার কোনো চিন্তা নেই। তুমি কালকে এসো। আমরা সন্তুষ্টচিত্তে তা গ্রহণ করলাম এবং আগামী কাল আসবো বলে সালাম বিনিময় করে বিদায় নিলাম।

তেসরা কথা
পরের দিন যথারীতি বাদ আসর হাজির হলাম রেদওয়ানুল হকের কাছে কিন্তু কপাল মন্দ। রেদওয়ান সময় দিতে পারলো না। তার পত্রিকার মিটিং থাকাতে আমাকে একাই যেতে হবে। আমি কেজি দুয়েক মাল্টা আর কেজি খানেক আপেল ক্রয় করলাম। কারণ একজন মুরব্বির কাছে গতকাল গেলাম কিন্তু তার জন্য কোনো তোহফা নিলাম না এটা দেখতে কেমন খারাপ লাগলো। তাই কিছু তোহফা নেয়া। এই কাজটি মল্লিক ভাই করতেন। আমি তাঁর কাছ থেকে শিখেছি। মল্লিক ভাই যখন কোনো কবি, সাহিত্যিক বা বুদ্ধিজীবিদের বাসায় যেতেন তখন তিনি খালি হাতে যেতেন না। পয়সা না থাকলে ধার করে হলেও কিছু উপঢৌকন নিয়ে হাজির হতেন। এতে করে মেজবান যেমন খুশি হতেন তেমন মেহমানেরও ভালো লাগতো। মল্লিক ভাই বলতেন এটা রসুল সা.-এর সুন্নত। আমি শুধু রসুলের একটি সুন্নত জারি রাখার চেষ্টা করছি।

মাগরিবের সালাত শেষ করেই আমি হাজির হলাম আল মাহমুদ-এর বাসায়। গিয়ে দেখলাম মাহমুদ ভাই সালাত আদায় করে একটু বিশ্রাম নিচ্ছেন। আজ তাঁর শারীরিক অবস্থা একটু নাজুক। আজ গত কাল থেকেও আমার কাছে দুর্বল মনে হচ্ছে। তবে তার শুভ্র হাসিটা লেগে আছে সেই আগের মতোই। বললেন- কে নিজাম এসেছো। আমি বললাম- জ্বি মাহমুদ ভাই নিজাম। বসো আমার শরীরটা তেমন একটা ভালো নেই। আমি বললাম তা হলে আমি আজকে চলে যাই কালকে আবার আসবো। মাহমুদ ভাই বললেন না, যখন চলেই এসেছো আর তোমাকে ফেরাবো না। তোমাকে একটা লেখা দেয়ার চেষ্টা করি। আগে চা খাও। বিকালের নাস্তা এলো, খেলাম দুজনে। মাহমুদ ভাই জিজ্ঞেস করলো মালটা এনেছো? আমি বুঝতে পারলাম না। না বুঝেই বললাম জ্বি মাহমুদ ভাই মাল্টা তো এনেছি, সাথে আপেলও এনেছে। আরে না মিয়া মাল্টা না মাল। লিখতে যখন বসেছি মাল’টা পেলে একটু যোস আসে। আমি হু হু করে হেসে দিলাম। জ্বি মাহমুদ ভাই এই তো হাজির। এই নেন প্যাকেট। প্যাকেটটা খোলো মিয়া। একটু খোলে দেও হাতে ধরি। মাল হাতে না ধরলে মজা পাওয়া যায় না। মালের স্পর্শ আনন্দ দেয়। মাল মানুষকে চাংগা করে। বুঝলা মিয়া। আমি জ্বি বলে যথারীতি প্যাকেট খুলে হাতে দিলাম। মাহমুদ ভাই কিছুক্ষণ পরখ করে প্যাকেটে রেখে দিলন। তারপর বললেন একটা সিগারেট ধরাই। জ্বি মাহমুদ ভাই। কাজের মেয়েকে ডাক দিলো মেয়েটি নিদের্শ মতো একটা সিগারেটের প্যাকেট ও একটি ম্যাচ দিয়ে গেলো। এবার আয়েস করে একটি সিগারেট ধরিয়ে টানতে থাকলো। তা হলে শুরু করি কী বলো- জ্বি মাহমুদ ভাই শুরু করেন।
    কথা বলি নিজের সাথে
    আবার কখন বলিও না
    চলতে থাকি আপন পথে
    আবার কখন চলিও না।
    স্বপ্ন দেখি নিজে নিজে

দীর্ঘক্ষণ চুপ থেকে মাহমুদ ভই বললো পড়। আমি পড়লাম। তিনি আবার বললেন পড়। আমি পড়লাম। আবার দীর্ঘক্ষণ চুপ করে থাকলেন। আবার বললেন পড়। আমি আবার পড়লাম। তিনি বললেন-
    অর্থ কিছু বুঝিও না।

তিনি বললেন, আবার পুরোটা পড়। আমি পড়লাম। তিনি চুপ করে থাকলেন। একটু আরাম করে বসে সিগারেট টানলেন। তারপর বললেন পড়। আমি পড়লাম। এভাবে পাঁচ ছয়বার পড়লাম।
    আমার হাতে সোনার টাকা

তিনি বললেন, আবার পড়ে এসো। আমি পড়লাম। তিনি চুপ করে থাকলেন, এবার আমি নিজের থেকেই পড়তে থাকলাম। তারপর মিনিট তিনেক চুপ করে থাকলাম দুজনেই। মাহমুদ ভাই বললেন, আবার পড়। আমি পড়তে থাকলাম। মাহমুদ ভাই আমার সাথে সাথে আবৃত্তি করতে থাকলেন।
    কথা বলি নিজের সাথে
    আবার কখন বলিও না
    চলতে থাকি আপন পথে
    আবার কখন চলিও না।

    স্বপ্ন দেখি নিজে নিজে
    অর্থ কিছু বুঝিও না।
    আমার হাতে সোনার টাকা
শেষ হতেই তিনি বললেন,
    যত্রতত্র খুঁজিও না।

হয়েছেনি মিয়া। আবার পড়তো মাহমুদ ভাই বললেন। আমি বললাম হ্যাঁ হচ্ছে। আপনি বলে যান।
    আমার লড়াই আমার সাথে
    বরাই করার নেই কিছু
    নিজের সাথে যুদ্ধ জয়ের
একটু পড়। আমি পড়লাম। মাহমুদ ভাই আমার সাথে সাথে পড়লেন আর চেষ্টা করতে থাকলেন পরবর্তি লাইনটি লেখার জন্য।
    পা বাড়ালাম সেই কিছু
বাহ! আমিও বললাম বাহ! না বাহটা লেখো না।
    পা বাড়ালাম সেই কিছু
    জীবনটাতো জয়ের খেলা
    জয় করেছি
দীর্ঘক্ষণ চুপ থেকে বললেন আবার পড়। আমি আবার পড়লাম। মাহমুদ ভাই আমার সাথে সাথে আবৃত্তি করলেন শেষ হতেই বললেন
    জয় করেছি নিজকে কী।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম কি টা কি রস্বইকার দিয়ে না দীর্ঘইকার দিয়ে লিখবো। মাহমুদ ভাই বললেন দীর্ঘইকার দিয়েই লিখো।
    জয়ের কথা নিত্য ভাবি

মাহমুদ ভাই চুপ করে আছে বলে আমি  আবার পাঠ করলাম শেষ লাইনগুলো। কিন্তু তিনি চুপ করেই থাকলেন চোখ বুঝে। তিনি বললেন আবার পড় আবার পড় এই জায়গাটা
    জয় পরাজয় এক ভীতি।

তিনি বললেন দেখো ঠিক আছে কি না। আমি বললাম ঠিক আছে। তিনি বললেন আবার পড়। আমি পড়লাম। তারপর জিজ্ঞাসা করলাম কবিতার নাম কি দিবো। জয় পরাজয় দেও। বাহ! আমি বললাম একটি হয়ে গেলো আলহামদুলিল্লাহ। মাহমুদ ভাই বললেন হয়ে গেলো মানে একটি কবিতা হয়ে গেলো। আবার পড়। আমি সম্পূর্ণ কবিতাটি পড়লাম।

    জয় পরাজায়
    আল মাহমুদ


    কথা বলি নিজের সাথে
    আবার কখন বলিও না
    চলতে থাকি আপন পথে
    আবার কখন চলিও না।

    স্বপ্ন দেখি নিজে নিজে
    অর্থ কিছু বুঝিও না।
    আমার হাতে সোনার টাকা
    যত্রতত্র খুঁজিও না।

    আমার লড়াই আমার সাথে
    বরাই করার নেই কিছু
    নিজের সাথে যুদ্ধ জয়ের
    পা বাড়ালাম সেই কিছু।

    জীবনটাতো জয়ের খেলা
    জয় করেছি নিজকে কী
    জয়ের কথা নিত্য ভাবি
    জয় পরাজয় এক ভীতি।



চতুর্থ কথা
মাহমুদ ভাই বললেন ভালোই হয়েছে। আমি বললাম ছড়া ধর্মী লেখা হলো। মাহমুদ ভাই বললেন ছড়া ধর্মী হলেও এটার ভেতর আনন্দ আছে। জীবন সম্পর্কে গভীর বোধ আছে। আমি তো ভাবতেই পারিনি আমি লিখতে পাড়বো। আল্লাহর মেহেরবানিতে কবিতা হলো। থাক এবার তোমার কথা বলো। তোমার খবর কি? মাহমুদ ভাই আমার একটা মেয়ে হয়েছে।
- বাহ। ওলেকাম। মেয়ে হয়েছে বলে কি তোমার মন খারাপ হয়েছে।
- আমার মন সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে। আমি আনন্দিত হয়েছি।
- তোমার জন্য বাপ হওয়া তো অতুলনীয়। আচ্ছা যাই হোক আমি খুব খুশি হয়েছি যে তোমার একটা মেয়ে হয়েছে। এটা একটা খুশির খবর। এই খুশির খবরটা দিছো মিয়া, তোমাকে কি দেই। এই কবিতাটা তোমার মেয়েকে দিয়ে দিলাম। তোমার মেয়ের নাম কি রেখেছো।
- হাইফা তাননুর।
- লেখাটা দিও।
- কি নাম বললে?
- হাইফা। হাইফা তাননুর।
- অর্থ কি মিয়া।
- স্বাধীনতার আলোক বিচ্ছুরণ
- বাহ! ভালোইতো নাম রাখছো।
- হ্যাঁ মাহমুদ ভাই আপনাদের দোয়া।
মাহমুদ ভাইও খুশির হাসি দিয়ে বললেন, এবার একটা সিগারেট খাই। আমি সম্মতি সুচক মাথা নাড়লাম। কারণ আমি জানি মাহমুদ ভাই কবিতা লেখা শেষ হলে ক্লান্ত হয়ে যান। যেভাবে নারী সন্তান প্রসব করে ক্লান্তিতে এলিয়ে দেয় শরীর। মাহমুদ ভাইকে দেখেছি যখন একটি লেখা শেষ করে তখন আয়েশ করে একটি সিগারেট ধরায়। সোফায় এলিয়ে দেন শরীর। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার কথা বলেন। আর যখন সুস্থ্য ছিলেন নিজেই নিজের লেখা লিখতেন তখন নাকি তিনি একটি কবিতা লেখা শেষ করে বিছানায় শুয়ে পড়তেন। দীর্ঘক্ষণ শুয়ে থাকতেন বা একটি আয়েশি ঘুম দিতেন। আমিও ভাবলাম এটাইতো মাহমুদ ভাইয়ের প্রকৃতি অতএব তিনি সিগারেট ধরাবেন আর একটি বিশ্রাম করবেন।

শেষ কথা
মাহমুদ ভাই বিশ্রাম কিছু সময়। এবার শুরু হলো কথোপকথন।
- মাহমুদ ভাই আপনার চলাচলে কি কোনো অসুবিধা হয়।
- চলা ফেরা করতে অসুবিধা হয়। আরেক জনের সাহায্য লাগে। আরেকজন ধরে ধরে নিয়ে যায়। ইদানিং আমি চলা ফেরা করিও না।
- মাহমুদ ভাই জীবনের শেষ প্রান্তে এসে কেমন লাগছে জীবন। যেখানে আপনার ছোটরা যেমন মল্লিক ভাই, মান্নান সৈয়দ স্যার চলে গেলেন। আপনার সমসাময়ীক কবি শামসুর রাহমান। আপনি এখনো কালের স্বাক্ষি হয়ে আছেন। বটবৃক্ষের মতো আমাদের ছায়া দিচ্ছেন।
- এটাতো আল্লাহর রহমত। হায়াত হলো আল্লাহর রহমত।
- এই প্রান্ত সময়ে এসে আপনার উপলব্ধি কি?
- আমার উপলব্ধি মৃত্যু সম্বন্ধে। এটা একটা পরিমাণ্ ওটাও একটা পরিণাম। জীবন যখন আছে তখন মৃত্যুও থাকবে। জীবণ মৃত্যু সহদরা। এর মধ্যেখানে আমি লিখতে এসেছিলাম সেটা আমি করেছি এবং আন্তরিক ভাবেই করেছি। আমাদের একটা কাল ছিলো এটা ছিলো সৃজনক্রিয়ার সময় খুবই রিজনাবল এবং ফ্রুটফুল। এই কালটা নিয়ে আমরা গর্ব করি।

এটুকু বলেই মাহমুদ ভাই বললেন আমার খারাপ লাগছে। আজ এ পর্যন্তই অন্য দিন কথা হবে। জ্বি মাহমুদ ভাই। আজ বিদায় নেই। আল্লাহ হাফেজ।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.