Header Ads

Header ADS

নরেন_আফসার নিজাম


নরেন
আফসার নিজাম

সেনেটারি দোকানের ঠিক উল্টো দিকে যে ছোট্ট পান দোকানটি তার সামনে বাম পাশে বাঁশ পোতা অবস্থায় যে খুঁটি সেখানে বেঁধে রাখা হয়েছে। বেঁধে রাখার দৃশ্যটা দেখার আগ্রহ জনগণের মধ্যে যে কমতি নেই তার প্রমাণ পুরো রাস্তা জুড়ে জনসমুদ্র হয়েছে। বলা যায় মাইনষের মাথা মাইষে খায়। কার আগে কে দেখবে এই দৃশ্য, তার জন্য এক দফা ঝগড়া হয়েগেছে। কারো কারো মধ্যে হাতাহাতি যে হয়নি তা বলা যাবে না। দৃশ্যটি দেখার লোভ কেউ যে সামাল দিতে পারেনি তার উজ্জ্বল প্রমাণ বলা যায়। একজন দূর থেকে বলে,

- যারা দেখেছেন তারা সারেন। আমরা একটু দেখি।

কে শোনে কার কথা। শক্তি খাটিয়ে যে এগুতো পারে সেই সফলকাম। যেনো এই দৃশ্য দেখে তাদের চোখ শীলতল হয়। কেউ কেউ আছে একবার খুঁটির সামনে গেছে তো আর নট নরনচরন। কোনো প্রকারেই তাকে সরানো যাচ্ছে না। চলমান ক্যামেরার মতো তার চোখ দুটি সচল রেখেছে যেনো কোনো দৃশ্য কেটে না যায়। তার চোখ যেনো একটি মাস্টার ক্যামেরা। এই ক্যামেরা থেকে কোনো প্রকারেই তার চোখ সরানো যাবে না।

খবরটি যে শুধু এ এলকায় ছড়িয়ে পড়েছে তা নয়। আশে পাশের সকল গ্রামেই ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ দল বেধে আসছে এই দৃশ্য দেখার জন্য। দৃশ্যটা যে মনোরম, মনোহর তা কিন্তু নয়। দৃশ্যটি করুণ আবার বীরত্বেরও বটে। এ দৃশ্য দেখবে বলে অনেকদিন অপেক্ষায় ছিলো গ্রামের লোকজন তা নয়। গ্রামের লোকজন তো কোনো দিনই কল্পনা করতে পারেনি এমন একটি দৃশ্য তাদের চোখের সামনে ঘটে যাবে।

খবরটি ফজরের নামাজের পরে ছড়িয়ে পড়েছে। সেই থেকে শুরু। খুঁটির সাথে বাঁধা অবস্থায় আছে। শুধু বাঁধা অবস্থা! তা নয়। শুধু খুঁটির সাথে বেঁধে রেখে তারা শস্তি পাচ্ছিল না। তাকে প্যাকেট করা হয়েছে। প্রথমে চারটি আড়াই মনি চটের বস্তা কেটে সিলাই করা হয়েছে। সেই বস্তা দিয়ে পেঁচিয়েছে। এরপর শক্ত পাটের রশি দিয়ে বাধের পর বাধ দিয়ে পেঁচিয়ে প্যাকেট করেছে। যাতে করে কোনো প্রকার নড়ন চরন করতে না পারে। এই আগে অনেকবার তাকে ধরা চেষ্টা করা হয়েছিলো। কিন্তু কিছুতেই কিছু করা যায়নি। চির অধরা হয়েই যেনো সে জন্ম নিয়েছে।

তাকে দেখলে যে কেউ ভয় পেয়ে যায়। সাড়ে সাত ফুট লম্বা। পাহাড়ের মতো শরীর। লম্বা লম্বা চুল। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে মনে হয় একটি হাতি চলে যাচ্ছে। এই হাতির চোখগুলো একদম পেঁচার মতো। বড় বড়। যেনো রাতে দেখার জন্যই এই চোখ সৃষ্টি হয়েছে। যে চোখ পেঁচার মতো সে চোখ তো রাতেই ভালো দেখে। সেতো নিশাচর। রাতে তার আনা গোনা। দিনের আলো তার তেমন গা সয় না। নরেন ঠিক তেমনি। দিনের বেলা তাকে কেউ বেশি একটা দেখে না। রাত হলেই নরেনের চলাচল শরু হয়। বিড়ালের মতো পা টিপে টিপে হাঁটে। পেঁচার মতো চেয়ে থাকে।

নরেন হাতির মতো শরীর নিয়ে শক্তিশালী পুরুষ, সেই পুরুষত্ব দেখানের জন্য কোনো দিন কারো গায়ে হাত দিয়েছে তেমন কোনো রিপোর্ট কেউ দিতে পারবে না। বরঞ্চ নরেন কারো দেখলে তাজিমের সহিত রাস্তা ছেড়ে দাঁড়িয়ে নমস্কার বলে। এই বিনয় যেনো উত্তরের ঝড়ে নুয়ে পড়া কলাগাছ। নরেন ঠিক তেমনি।

নরেন কি কাজ করে তা সবাই জানলেও কেউ কোনো দিন কাজ করতে দেখেছে তেমন কোনো উদাহরণ কেউ দিতে পাবে না। একদিন মসজিদের হুজুর জিজ্ঞেস করে
- কি নরেন কিছু একটা করো। এমনি এমনি তো আর জীবন চলবে না। এরকম করতে থাকলে তোমার কপালে দুঃখ আছে।
নরেন খুব বিনয়ের সাথে মাথা দুলাতে দুলাতে বলে
- হুজুর আমি তো ভালো হয়ে গেছি। আর করবো না এ কাজ। এবার আপনার কথা রাখবো।

নরেন এরকম কতো জনকে যে কথা দিয়েছে তার কোনো ইয়াত্তা নেই। সমাজের নামি দামী সম্মানী লোক দেখলেই তার কাছে ইরাদা করে। সে ভালো হয়ে যাবে। একেবারে ভালো হয়ে যাবে। কোনোবার যে ভালো হয়েছে তার কোনো চিহ্ন আজঅব্ধি কেউ খুঁজে পেলো না।

নরেন এবার ঠিক করে আর কোনো দিন সে এ কাজ করেব না। এইবারই শেষ বার। অনেক করেছে। কিন্তু আর না। সে মনে মনে বলে মনের জোড়ই সব জোড়। মনকে বাধতে পারলেই কেল্লাফতে। প্রতিবার যখন কারো কাছে ওয়াদা করে ঠিক তার পরদিন, তাকে মন আবার সেই কাজ করতে বাধ্য করে। এবার সে আর মনের কথা শুনবে না। তবে এবারই শেষবার। কারণ গত পরশু রাতে যখন রশীদ মিজির বাড়িতে ঢুকে তখন সাবই টের পেয়ে যায় কিন্তু টের পেলে কি হবে। তার কিছুই করতে পারেনি। শুধু পরনের লুঙ্গিটা খোয়া গেছে। রশীদ মিজিরা তিনভাই মিলেও তাকে ধরে রাখতে পারেনি। মিজি ভাইদের ব্যাঙ্গাচির মতো ছুড়ে ফেলে দিয়ে চলে এসেছে। এরকম তিনজন কেনো সাত ভাইও যদি তার কাছে আসে ভগবানের কৃপায় তার কিছুই করতে পারবে না।

কিন্তু এবার কি হলো। ভাবতেই নরেনের ঘৃণা লাগে। নিজের প্রতি নিজের ধিক্কার আসে।

খুঁটির চারপাশে ক্রমাগত ভীর আরো বৃদ্ধি পায়। এলাকার লোকজন জমা হতে থাকে। থানায় খবর যায় কিন্তু থানা থেকে কোনো দারোগা আসে না। নরেন বস্তার ভেতর থেকে মিনমিন করে বলে,
- চেরম্যান সাবরে একটু খবর দেও। আমি তার কতো কাজ করে দিছি। মেমবার সাবরে একটু খবর দাও। আমি তার কতো উপকার করছি।

কেউ একজন ধমক দেয়। কেউ একজন লাথি দেয়। কেউ কেউ থুতু দেয়। সেদিকে নরেনের কোনো দৃষ্টি নেই। সেই বিষয়ে তার কোনো ভাবনা নেই। সে মনে মনে ভাবে একবার চেয়ারম্যান সাব আসলে তার মুক্তি হয়ে যাবে। একবার মেমবার সাব আসলে তার মুক্তি হয়ে যাবে। কিন্তু তারা আসে না। চেয়ারম্যান মেমবারের গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যাবে বলে তারা শতর্ক। নরেনের পৃষ্টপোষক তারা তা যেনো কোনো প্রকারেই প্রকাশ না পায় তার জন্য চেয়ারম্যান মেমবার ব্যবস্থা নেয়। তারা থানাকে বলে দিয়েছে যাতে থানা থেকে কেউ সেখানে না যায়। জনগণ যেনো তার বিচার করে।

নরেন অপেক্ষা করে। সকাল গিয়ে বিকাল হয়। বিকাল গিয়ে সন্ধ্যা নামে। নরেন আবার ভাবতে থাকে। এবার তার প্রতি দারুণ ক্ষোভ হয়। যে নরেনের কাছে দশজন যোয়ান পোলা কিছু না সে কিনা। ছিঃ ছিঃ ভাবতেই গা গুলিয়ে আসে। একটি মহিলার কাছে ধরা খায়। ছিঃ নরেন ছিঃ।

নরেন রাত হতেই তার পেঁচা চোখ নিয়ে বেড়িয়ে যায় তার কাজ করেত। এবারই শেষ কাজটি করবে। আর কোনো দিন এ কাজ করবে না। ভগানের নামে বের হয়ে কাজ শুরু করে। খুন্তিটা আজ বেশ কাজ দিচ্ছে। খুন্তির ধার যেনো আজ বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ঠিক মতোই ধার দিয়েছে। আজ যে মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে এটাই তার প্রমাণ। নরেন সিঁদ কেটে একটু জিড়িয়ে নেয়। কাজ করতে আজ বেশ ভালো লাগছে। মনটা বেশ ফুরফুরা মনে হয়। মনের সুখে একটি বিড়ি ধরায়। যদিও এ কাজটি সে কোনো দিন করে না। কিন্তু আজ তার বিড়ি খেতে বেশ ভালো লাগছে। বিড়ি শেষ করে ছোট্ট টর্চ দিয়ে দেখে নেয়ে ঘরের অবস্থা। নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে বাড়ির নতুন বউটি। গলায় সুন্দর হারটি বেশ ঝিলিক দিয়ে উঠে। কানের দুলটিও বেশ। কফিল সারেঙের বেটাবউ তো। গয়না দিয়ে সাজানো। বেশ মায়া লাগে। তবু কাজ যখন করতে এসেছে, কাজটি সেরেই যাবে। মায়া দিয়ে জগৎ সংসার চলে না। কাজ দিয়ে জগৎ চলে, মনে মনে ভাবে নরেন। তার কাজটি সে করবে। কাজের মাঝেই তো পূন্য লুকিয়ে আছে। কফিল সারেঙের বেটা বাড়ি নেই, সেটা সে জেনেই এসেছে। বেটা মানুষ থাকলে একটু ঝামেলা হয়। আজ শেষ কাজ তাই নরেন কোনো ঝামেলা পোহাতে চায় না। বিনা বাধায় আরামসে কাজটি শেষ করবে। জীবনের শেষ কাজ নির্ভেগ্নে হলেই ভালো।

নরেন ভগবানের নাম জপে প্রথমে খুব সুচারুভাবে গলার হারটি খুলে আনে। বেশ হয়েছে। এমন সুচারো ভাবে আর কোনো দিন সে কাজ করেছে বলে মনে করতে পারে না। প্রতিটি কাজেই তার কোনো না কোনো ঝামেলা হয়। তবে আজ কোনো ঝামেলা হয়নি। গতবছর শীতকালে পঙ্কজ দেব নাথের বউয়ের হারটি খুলতে গিয়ে ঠিক বুকের উপর হাতের চাপ লাগে। ছিঃ ছিঃ এমন একটি বদ কাজ যে হয়ে যাবে তা সে কোনোদিন ভাবেনি। বউটিও নিজের স্বামী ভেবে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু একটু পরে বিকট চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলে। কি আর করা কাজটি শেষ না করেই তাকে ফিরতে হয়।

এবার তেমন কিছু হয়নি। যদিও সারেঙেরে বেটাবউটি বেশ সুন্দর। বুচির মায়ের মতো পেতিœ নয়। বুচির মা জীবনে কোনো দিন ভালা কাপড় পড়েছে তেমন স্মৃতি নেই। বুচির মা পাবে কোথায় নিজে যা কামাই করে তাতো খাওয়ায় জোটে না। ঈদের সময় যখন চেয়াম্যান সাব জাকাতের কাপড় দেয় তখন বুচির মায়ের জন্য একটি কাপড় পায়। সে কাপড় দুদিন না যেতেই তেনা তেনা হয়ে যায়। নিজে একটা লুঙ্গি পায়। সেটার অবস্থাও এক। এমন যখন অবস্থা তখন বুচির মার সৌন্দর্য চিন্তা করে না নরেন। কিন্তুসারেঙেরে বেটাবউটারে বেশ ভালো লাগছে। মায়া লাগছে। চলে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু জীবনের শেষ কাজ। কাজটি না করে গেলে সরাজীবন মনে আফসুস থাকবে। তাই কাজটি শেষ করেই যেতে হবে। নরেন সেই চিন্তা করেই মনের অজান্তে সারেঙের বেটা বউয়ের কানে হাত দিয়ে দুলটি টান দেয়। অমনিই জেগে ওঠে বউটি। চিৎকার করে। নরেন কিছু ভাবতে পারে না। পিছন ফিরে হামাগুড়ি দিয়ে পালাতে থাকলে সারেঙের বেটাবউ নরেনের বড়বড় চুলগুলো ধরে ঝুলে পড়ে। নরেনের পিছন থেকে চুল ধরাতে তেমন কিছুই করতে পানে। তারপরও কুনুই দিয়ে ক্রমাগত গাই দিতে থাকে। সারেঙের বেটাবউ কোনো প্রকারেই ছাড়ছে না। যেনো জীবন গেলোও সে তার গয়না নিয়ে পালাতে দেবে না। তার চিৎকারে বাড়ির সবাই জেগে ওঠে আর তাকে বেধে পিটাতে থাকে।

ছিঃ শেষ পর্যন্ত একটি মহিলার কাছে ধরা খেলো। ছিঃ এই মুখ দেখোনোর চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো। সারা জীবন কেউ নরেনের টিকিটি পর্যন্ত ধরতে পারলো না। সেখানে একটি মহিলার কাছে। ছিঃ ছিঃ। নরেন আর ভাবতে পারে না।

দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। মানুষের আগ্রহের ভাটা পড়ে। রাত্রী গভীর হয়। অন্ধকার গিলে খায় চারপাশ। দশ হাত দূরেরও কেউ কাউকে দেখে না। নরেনের পেঁচা চোখ গুটগুটে অন্ধকারেও দিনের মতো দেখতে পায়। কিন্তু আজ তার দেখার কোনো সুযোগ নেই।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.