Header Ads

Header ADS

‘একদিন জল হব’ বলে উড়াল দিলে মেঘরাজ্য থেকে মর্তলোকের বৃষ্টি হয়ে যায় ইসমত শিল্পী_আফসার নিজাম


কবিতার ভাষা কি হবে। কী হবে শারিরীক রূপ। কেমন করে চলবে সে। তা নিয়ে বিস্তর বয়ান থাকলেও পত্ররচনা নিয়ে তেমন কোনো বয়ান লক্ষ করা যায় না। তবে সাহিত্যের পাশাপাশি নিজেকে মেল ধরার একটি প্রবণাতা সৃষ্টি হয়েছে এই পত্রকাব্যের মাধ্যমে। একজন মানুষ পত্রের মাঝে অনায়াসে বয়ান করে তার মারেফতী বয়ান, যা অন্যের সামনে কইতে পারে না। পত্ররচনার সময় মনের ভেতর থাকে না লাজের ঘোমটা, ভয়ের আতঙ্ক, প্রণয়ের শিহরণ। সে অনায়সে বয়ান করতে থাকে মনের বাসনা। গোপন কথা। যে কথা সচারাচর কইতে মানা, সে কথা লাজ ভাঙা জোয়ারের মতো কইতে থাকে পত্রে মাঝে। এমনি এক পত্রকাব্য রচনা করেছেন ইসমত শিল্পী।

ইসমত শিল্পীর পত্রকাব্য পড়তে গিয়ে পাঠকের মনে হবে দুজন মানুষের কথা। একজন অন্যজনের কাছে অনায়াসে বায়ান করছে তার ভাব। নাগরিক জীবনের যতো যন্ত্রণা উগলে দিচ্ছে তার পত্রকাব্যে। কতো যে না বলা কথা নিজের অজান্তে কইতে থাকে তার ইয়াত্তা নাই- ‘জানিস অতনু, আজ বৃষ্টিতে আসতে ঘোলা জলের ভেতরে রিকশাটা পড়ে গেলো। একটা প্রাইভেটকারের ধাক্কায়; প্রাইভেটকারটি শাদা ছিলো। পড়তে পড়তে দামি গ্লাসের ভেতর দিয়ে ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, খুব রাগ হলো কিন্তু কিছুই বলতে পারলাম না। ব্যথায় পায়ের গোড়ালিটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল। ড্রাইভারটিই আবার উল্টো রিকশাওয়ালাকে ধমক দিলো।’ এই যে নাগরিক যন্ত্রণা। যা তাকে বিদ্ধ করে, কষ্ট দেয়, মনকে মেঘাচ্ছন্ন করে তোলে। এই কথা নগরপিতাকে বলতে পারে না কিন্তু অনায়াসে অতনুর কাছে মনের কথা বলে যাচ্ছে পত্রকাব্যের মাধ্যমে।

এই পত্রকাব্য পাঠ করতে গিয়ে পাঠক বারবার প্রশ্ন করতে থাকবে কে এই অতনু! তার পরিচয় কি! তাকে দেখতে কেমন লাগে। তাকে দেখলে কি প্রেম করতে ইচ্ছে করে। সে কি ভার্চুয়াল জগতের কেউ! না কি সে রক্ত মাংশের গড়া আদম। এইসব প্রশ্নের মাঝে যখন পাঠক খাবিখায়, তখন সামনে এসে দাঁড়ায় লেখক। এই লেখকই কি তাহলে অতনু। হ্যাঁ লেখই অতনু। একজন মানুষের ভেতর বাস করে অন্য এক মানুষ। তার সাথে লড়াই করে, তার সাথে ঝগড়া করে, তার সাথে অভিমান করে, তাকে আদর করে। সে যেনো পৃথিবীর সবচেয়ে আপন জন। তাকে ছড়া চলে না একটি মুহূর্ত। তাকে ছাড়া বাঁচে না প্রাণ। কবি তার দ্বিসত্ত্বাকে এখানে চমৎকার ভাবে উপস্থাপন করেছেন। একদিন জল হব বলে ইসমত শিল্পী আমার আমি আর মনে আমি একভুত না করে মুন্সিয়ানার মাধ্যমে আমার আমিকে আড়াল করে মনের আমিকে অতনু হিশেবে গড়ে তুলেছেন। পাঠকের সামনে এই মুর্তি কখনো মুর্তিমান হয়ে ধরা দেয় কখনো জ্বীনের মতোই ভার্চুয়াল হয়ে যায়। তখন কবি বয়ান করে- ‘অতনু, তুই পাথর হয়ে থাকতে চাস যদি, থাক। তবুও নিথর হতে চাস না। আমি তবে প্রজাপতি হয়ে পাথর জমিন ছোঁবো। ঢেউয়ে ঢেউয়ে সমুদ্র মাতাল স্বরে গান শোনাবো দিনমান- বাতাস কাঁদলে কাঁদুক, আমি আর কাঁদবো না। নীল শাদা পাথরের রঙে সাজাবো নতুন সবুজ। বুকের জমিন চিরে ভেসে উঠবে ফসলের ঘ্রাণ। তুই তবে শুভ্র, রঙিন পাথর! আমি নীল প্রজাপতি!!’ শুভ্র পাথর আর নীল প্রজাপতি এ দু’টি রূপই কবি’র রূপ। কারণ এই দুই চরিত্রই কবি ইসমত শিল্পী’র ভেতরের আমি বাহিরের আমি। একে অপরের প্রতিরূপ হিশেবে হাজির হয় পাঠকের সামনে।

একজন কথাশিল্পী একজন কবি। একজন কবি একজন কথাশিল্পী। একে অন্যের আদল গ্রহণ করে বয়ান করে তাদের মনের কথা। যখন একজন স্রষ্টার মনোরাজ্যে এই দুই সত্ত্বা বিরাজ করে তখন সে হয়ে ওঠে মৌলিক স্রষ্টা। এই মহৎ গুণাবলী সমৃদ্ধ লেখা পাই রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের ভেতর। রবী ঠাকুর তার লিপিকার গল্পগুলো রচনা করেন এমনই এক ঘোরলাগা ভাষার মধ্য দিয়ে। পাঠক যখন সেই লেখায় অবগাহন করে তখন সে ভেসে যায় আর ‘একদিন জল হব’ বলে সাগর বক্ষে জল হয়ে সাঁতার কাটে। তেমনই নজরুলের ব্যথার দান উপন্যাস পাঠ করলে পাঠক কাব্যময়তায় তন্দ্রাচ্ছ্বন্ন হয়। ইহলোক আর মর্তলোকের যে ভাষা তা ভুলে যায় পাঠক। সে তখন মেঘর রাজ্যে ভেসে বেড়ায়। আমি ‘একদিন জল হবো’ বলে বৃষ্টি হয়ে যায়। ইসমত শিল্পী সেই কাব্যপত্রের ঐতিহ্য নিয়ে খাড়া হয়েছেন পাঠকের সামনে। তার সাবলীল বায়ান পাঠককে মুগ্ধ করে। সে পাঠকের মুখেই বয়ান করে তার কথা। তখন পত্রলেখকের পত্রকাব্য না হয়ে পাঠকের পত্রকাব্য হিশেবে মুর্ত হয়। আর পাঠক তার নিজের ভেতরের আমিকে আবিস্কার করে ‘একদিন জল হবো’ বলে উড়াল দিয়ে মেঘরাজ্য থেকে মর্তলোকের বৃষ্টি হয়ে যায়।

রবী ঠাকুর তার লিপিকাতে অনেকগুলো কাব্যগল্প সংযুক্ত করেছেন। অনেক চিন্তাকে সমন্বিত করেছেন। একটি চিন্তা অন্যচিন্তা আলাদা। আবার মুক্তার মালার মতো একই সুতোয় গাঁথা। একটি চিন্তা থেকে আর একটি চিন্তা আলাদা করা যায়। তবে চিন্তার ধাপ বা সিঁড়ি রেখেছেন সমান্তরাল। তাই লিপিকা সাহিত্যমোদীদের কাঝে আজও বিস্ময়। ইসমত শিল্পীর এই পত্রকাব্যও বিভিন্ন চিন্তা নিয়ে বেড়ে ওঠেছে। একটি চিন্তা থেকে আর একটি চিন্তা আলাদা কিন্তু একই সুতোয় বাঁধা। ইসমত শিল্পী বিভিন্ন সময় মনের মাঝে যে চিন্তাগুলো সাজিয়েছে তারই লিখিত রূপ ‘একদিন জল হব’ পত্রকাব্য। তাই দেখি কবি’র চিন্তা এক সময় থেকে অন্য সময়ে ভ্রমণ করে। নিজের সাথে নিজের বিবাদের মতো চিন্তা থেকে সরেও এসেছে- ‘অতনু, বদলে যাওয়া সবসময় হেরে যাওয়া নয়। বদলে যেতে পারলে কখনও কখনও জিতে যাওয়া যায়। যদি একটু বদলাতে পারা যেত; তুই অথবা আমি। কিন্তু একটি কথা কি জানিস? যারা বদলাচ্ছে তারা কেমন যেনো দৌঁড়চ্ছে। এমনকি সবকিছুই মন্দের দিকে। ভালো কিছু নিয়ে বদলাতে হলে তো ধীরে ধীরে এগুতে হয়। চারপাশে এসবের সংখ্যা খুবই নগন্য। তাহলে? এমন বলানো তো বদলাতে পারি না, মন্দের দিকে। তাই তো চুপ করে থাকি।’ কবি এখানে বদলানো বিষয়ে যে তর্ক হাজির করেছেন তারপর তার বিপরীত আর এক মত উপস্থাপন করে- ‘অতনু, বাতাসগুলো কেমন যেনো হালকা হয়ে যাচ্ছে ইতানিং। কার্তিকের বাতাস কি এমন হালকা হয়; তোর কি জানা আছে? হেমন্তের বাতাসে গন্ধ বদলায়, রোদের উত্তাপ বদলায়- কেমন একটা গা’ ঘেঁষা ঘেঁষাভাবে রোদগুলো আদুরে একটা আমেজ দেয়। হেমন্তের বাতাসে কি অনেক কিছুর ঘনত্বও বদলায়? যেমন মানুষের অন্তর, বিবেক, বোধ। সবই যেনো ফিকে; কোনো ভারিক্কি ভাব নেই কিচ্ছুর মধ্যে। সবই যেনো কাঁশফুলের মতোন, নূয়ে পড়ছে, ঝরে পড়ছে। কারোর কোনো ভ্রুক্ষেপটি নেই। এক সময় বদলানোর কথা বলছেন পরবর্তীতে বদলানোর বিরুদ্ধে বয়ান করছেন। আবার নিজেই তত্ত্ব হাজির করছেন ধীরে ধীরে বদলানোর বিষয়ে।

পৃথিবীতে নতুন কিছুই নেই। একজন সৃজনশীল মানুষ তার মনন ও সৃজনকে শুধু নিজের মতো বয়ান করেন। যখন তা আমি’র সাথে মিলে না যায় তখন তাকে নতুন বলে ধরে নিই। আর সকল কিছু আমি’র বিপরীতে যেতে হবে তা নয়। আমির মাঝেই তো অপর আমি বিরাজ করে। তাকে মুর্শিদ করে আমরা এগিয়ে যাই। এইযে পরমপরা এটা না থাকলে মানবজীবন বৃথা হয়। কারণ বাবা আছে বলেই তো আমি। মা আছে বলেই তো আমি। আমি তাকে স্বীকার করি না, তার রক্তের ঋণ শোধ করে ঘোষণা দেই এই আমি সেই আমি। যেই আমি তুমি, সেই আমি, আমার আমি, এর মাঝে বিরাজ করে আমার চিহ্ন। ইসমত শিল্পী সেই আমি’র আমি নিয়ে হাজির হয়েছে পত্রকাব্যে। এই পত্রকাব্য যুগের একটি চিহ্নমাত্র। আশা করি আমাদের নাগরিক যন্ত্রণার মাঝে তাকে চিহ্নিত করবো, অসংখ্য চিহ্নের মাঝে আরও একটি চিহ্ন হিশেবে। আর আমরা অবলোকন করবো ‘একদিন জল হব’ বলে সাঁতরে যাচ্ছেন ইসমত শিল্পী।

‘একদিন জল হব’ বইটি ইসমত শিল্পী পত্রকাব্য। ২০১৬ একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশ হয়। বইটি প্রকাশনা করেছে শিখা প্রকাশ। যার বিনিময় মূল্য ধারা হয়েছে ১৩৫ টাকা।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.