Header Ads

Header ADS

কান্না_আফসার নিজাম


কান্না
আফসার নিজাম


প্রথমে আস্তে, তারপর ধীরে ধীরে সংক্রমিত হয় সবার মাধ্যে। এ ঘর থেকে ও ঘর হয়ে গোটা মহল্লা মোবাইল নেটওয়ার্কের মতো নিজের কব্জায় নিয়ে নেয় শব্দটি। মহল্লার লোকজন যেনো ওয়াকিবহাল ছিলো, আওয়াজটা শুনতে পাবে। এজন্য সবার চেহরায় একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন ফুটে উঠতো নিজেদের অজান্তেই। প্রতিদিনই তারা খোঁজ নেয়ার জন্য প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতো-
‘খবর কী?’
‘না, আগের মতোই ...’
যখন শুনতে পায় ‘আগের মতোই’ তখন ‘আগের মতোই’ শব্দটা তাদের তৃপ্ত না করে কাঙ্খিত শব্দ শোনার তৃষ্ণা বৃদ্ধি করে। এ জন্য তারা দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে। সেই কাঙ্খিত শব্দটি কেমন হবে তারা জানে না। তারপরও শুনতে পাবে বলে তারা অপেক্ষা করে। আর সেই মোক্ষম শব্দটি শুনতে পায় না বলেই নিজেরা নিজেদের ভেতর একপ্রকার মানসিক চাপ বোধ করে; আর একে অপরের সঙ্গে দেখা হলে অনুভব করে, কিভাবে তাদের ধমনিতে রক্তস্রোতের গতি বৃদ্ধি পায়। তাদের মুখ থেকে কথা লোপ পায়। আকার-ইঙ্গিতে শব্দ করে। সেই শব্দ ফিসফিস আওয়াজ তুলে বাতাসে মিশে যায়।

দুই.
অবশেষে ফজরের আজানের পর তারা শুনতে পেলো সেই কাঙ্খিত শব্দটি। সেদিনের ফজরের আজানের ধ্বনি তাদের মনে হলো ঈসরাফিলের শিংগায় দ্বিতীয় ‘ফুঁ’। তারা ছুটতে থাকলো শব্দটির উৎসের দিকে। আর তারা অনুভব করতে থাকলো শান্তি। গলায় বিঁধে যাওয়া কাঁটা বড় একটা ভাতের দলার সাথে নেমে গেলে যেমন আরাম বোধ হয় অথবা শান্তি অনুভব করতে থাকে দীর্ঘদিন কোষ্ঠকাঠিন্যের পর প্রথম ত্যাগের মতো, ঠিক তেমনি। এই শান্তিবোধের সাথে স্মৃতিমন্থন করতে থাকে, দীর্ঘদিন কি অস্থিরতায় না তারা জীবন যাপন করছিলো। তাদের অপেক্ষার শেষ হয়েছে ফজরের আজানের সাথে সাথে। ফজরের আজান যে শান্তি আনয়ন করে, কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টি করে; আজ তারা এর সত্যাসত্য অনুভব করলো। এর আগে কখনো এমন নিবিড়ভাবে অনুভব করেনি। বলা যায়, অনুভব করার সুযোগ আসেনি। আজ এই শব্দটি যেন সুযোগ এনে দিয়েছে আজানের মর্ম অনুধাবনের।

তিন.
তারা ছুটে গেলো শব্দটির উৎসের দিকে, সেই বাড়ির দিকে। তাদের আগমনকে লক্ষ্য করে বাড়ির নিুস্বরের কান্নাগুলো উচ্চ শব্দ করে বেজে উঠলো। তারা এমনভাবে কান্না জুড়ে দিলো; যেনো এই কান্নার জন্য কতকাল অপেক্ষা করে ছিলো। কান্নার প্রবাহ খুব বেড়ে যায়। টইটম্বুর পুকুরের পানি আইল কেটে দিলে যেভাবে নেমে আসে ঠিক সেইভাবে তাদের চোখের পানি নেমে আসতে থাকে চোখের কার্ণিশ বেয়ে। তারা অনুভব করে, বুকের ভেতর কারা যেনো কিছু একটা পাথর চাপা দিয়ে রেখেছিলো; যা আজ নেমে গেলো চোখের পানির সাথে। যেভাবে ঝর্ণার পানির সাথে নুড়ি নেমে আসে নদীর ভেতর, সেভাবে নেমে গেছে বুকের পাষাণ।

কান্নার যে এতো আনন্দ তা আজই বুঝতে পারলো হাফিজ উদ্দিন। তার মনের মধ্যে বারবার একটা প্রশ্ন ঠেলাঠেলি করতো।
‘মানুষ কান্দে কেনো? মসজিদের ভিতরেওতো দেখি জোয়ান পোলাপানগুলা দুই হাত তুইলা কান্দে। বুঝলাম বুইড়া মানুষ না হয় মরণের ভয়ে কান্দে। কিন্তু জোয়ান পোলাগুলাই কান্দে কে? কাইন্দা বা কি সুখ পায়? না কি কোন দুঃখে কান্দে। জোয়ান পোলাগো আবার দুঃখ কি? তাদেরতো একটাই গান দুনিয়াটা মস্ত বড়- খাও দাও ফুর্তি করো। নাহ! ফুর্তি না কইরা পোলাপানগুলাই কান্দে।’

কান্দে কেনো এই কথাটাই হাফিজ উদ্দিনের মাথার ঢুকতো না। কিন্তু আজ সে অনুধাবন করতে পারলো কান্নার আনন্দ। মসজিদের হুজুর কান্নার ফজিলত বর্ণনা করার সময় কতইনা ইয়ার্কি করেছে। আজ সেই কান্নাই তাদের মুক্তি দিলো। এই কান্নার জন্য কত রাত নির্ঘুম থেকে অপেক্ষা করেছে। প্রতিদিনই কান্না করার জন্য মাগরিবের নামাজের পর উত্তরপাড়ার জাকেরানের সাথে জিকিরে মশগুল হয়েছে। জিকির শেষে মুনাজাতে চোখের পানিতে সবার পাঞ্জাবী ভিজে গেলেও তার চোখে খাঁখাঁ চৈত্রের দুপুর রয়ে যেতো। অথচ হুজুর যখন বলেন-
‘কান্দো মিয়ারা কান্দো; নিজের পাপের কথা মনে কইরা কান্দো, আর খাস দিলে আল্লার কাছে মাফ চাও; আর কান্দো; কবরের আজাবের কথা মনে কইরা কান্দো।’
তখন হাজিরানে মজলিসের কান্নায় বাতাস ভারি হয়ে গেলেও হাফিজ উদ্দিন যেনো কান্নার মেঘটুকুও জড়ো করতে পারতো না। চোক্ষের দরিয়া কারবালা হয়ে গেছে। হাফিজ উদ্দিন এ সময় সত্যিই অসহায় বোধ করে। আর চিৎকার করে বলতে থাকে-
‘আমি বুঝি পাগল অইয়া যাইতাছি। আল্লাগো আমার দুই চক্ষে এক ফোঁটা পানি দাও। আমার দুই চোখ কারবালা অইয়া গেছে। আমার চোক্ষে এক ফোঁটা বৃষ্টি দাও। খোদা আ আ আ।’
এইরকম বৃষ্টিহীন চোখে দীর্ঘদিন পর যখন পানির স্রোত সৃষ্টি হয়েছে ফজরের আজানের পর, তখন ফজরের আজানই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আজান। হাফিজ উদ্দিনের এই কথাটাই বারবার মনে হচ্ছে।

চার.
কান্নার আনন্দে ক্লান্ত হাফিজ উদ্দিন এবার আবিষ্কার করার চেষ্টা করে কে প্রথম কান্না করেছে। কার কান্নায় মহল্লাবাসী জেগে ওঠে ফজরের আজানের সাথে সাথে।
‘বাবুল হুজুর মনে হয় প্রথম কাইন্দা উঠতে পারে। কারণ আজান দেওনের জন্য সে-ই মহল্লার সবার আগে ঘুম থেইকা ওঠে।’
‘না হুজুর হইবো কেন? সে যদি আগে কাইন্দা থাকে তাহলে আজানের সাথে সেই কান্দন মিইশা থাকনের কথা। আজানের সময় সেরকম কিছুইতো বোঝা গেলো না।’
নিজের সাথেই তর্ক করে হাফিজ উদ্দিন।
‘তাহইলে আমার কাজের মেয়েটি হইবো। কিন্তু সেতো রাইত বাড়নের সাথে সাথেই মইরা যায়। যে মরার মতো ঘুমায় সে প্রথম কানতে পারে না।’
‘তাহইলে কি প্রথম কানলো অছিমনের মা। বুড়িতো সারারাত ঘুমায় না। একলা একলাই কথা কয়। এই হাসে এই কান্দে। তার কান্দারতো কোন দাম নাই।’
তাই অছিমনের মায়ের প্রথম কান্নার সম্ভাবনাকে হাফিজ উদ্দিন নাকোচ করে দেয়। কিন্তু এবার সত্যি সে চিন্তিত হয়ে পড়ে। তাহলে প্রথম কাঁদলো কে? যার কান্নার মাধ্যমেই মুক্তি পেল মহল্লাবাসী। তাকে খোঁজা জরুরি মনে করে আবার চিন্তা করতে থাকে হাফিজ উদ্দিন। এবার তার চোখ পড়ে নূরুর পোয়াতি বউয়ের ওপর।
‘নূরুর পোয়াতি বউ অইবো। রাইতে বাইরে গেলে কিছু একটা দেইখা ভয়ে চিৎকার করে, তারপর সেই চিৎকার একসময় কান্দন হইয়া ছড়াইয়া পড়ে।’
‘কিন্তু পোয়াতি বউতো একলা বাহির হওয়ার কথা না। নূরুও বউয়ের সাথে বাহির হওয়ার কথা। নূরুর মুখেতো তেমন কিছু শুনলাম না।’
‘তাহলে কি আমিই প্রথম কাইন্দা উঠছিলাম। আমার চোখেই প্রথম পানি বাহির হইছে।’
হাফিজ উদ্দিন নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে উত্তেজিত হতে থাক।
‘তাহলে আমিই প্রথম কাইন্দাছিলাম। তাহলে আমিই প্রথম কানছিলাম। ও খোদা।’
বলে চিৎকার দিয়ে ওঠে হাফিজ উদ্দিন। প্রথম কান্নার সফলতায় তার দুইচোখ বন্ধ হয়ে আসে।

পাঁচ.
চৈত্র মাসের প্রথম দিকের কথা। কত তারিখ হবে? তারিখটা মনে করতে না পারলেও বার’টা ঠিকই মনে আছে সবার। শুক্রবার। এশার নামাজের একটু পরেই হবে। কারখানার কাজ শেষ করে হাফিজ উদ্দিন, নূরু আর শাহেবালী বরাবরের মতো মসজিদের সামনে সরবত গাছের নিচে ক্লান্তি দূর করার জন্য বসলো। কিছুক্ষণ পরেই টের পেলো বাঁশঝাড়ের মধ্যে একটা কিছুর অস্তিত্ব। প্রথমে ভয় পেলেও নূরু সাহস করে টর্চলাইটা মেরে বসে সোজা বাঁশঝাড়ের ভেতর। আর তখই হো হো করে হেসে ফেলে সবাই।
‘মইষ ষ ষ ষ’
‘শালায় আইলো কইত্তে?’
ভয়কে জয় করার আনন্দে সবার প্রাণচাঞ্চল্য বৃদ্ধি পায়। আর তাদের কথার ফুলঝুড়িও মেলে ডালপালা।
‘কিন্তু হালায় ওহানে করতাছে কি?’
‘চলতো গিয়ে দেখি।’
এবার সবাই একযোগে উঠে গিয়ে লাইট মেরে পরখ করে। মহিষটা করছে কি? প্রথমে বুঝতে না পারলেও মহিষের কাছাকাছি গেলে বুঝতে পারে। মহিষটার বাঁকা-লম্বা দুটি শিং জালিবাঁশের চিপার মধ্যে আটকে গেছে। সম্ভবত দীর্ঘক্ষণ ধরেই শক্তি প্রয়োগ করে ক্লান্ত সে। হাফিজ উদ্দিন এবার উদ্যোগী হয়ে ওঠে, বাঁশঝাড় থেকে মহিষটাকে ছাড়িয়ে আনতে হবে। মহিষের বাঁকা দুটি শিং এমনভাবে প্যাচ খেয়েছে যে বাঁশ না কেটে উদ্ধার করার আর কোনো উপায় থাকে না। তাদের এই দস্তাদস্তিতে ত্রিশঘরের এই ছোট্ট মহল্লার কেউ আর বাকি থাকে না; মহিষের এই করুণ অবস্থা দেখার। অবশেষে বাঁশ কেটে হাফিজ উদ্দিন মহিষটাকে বাহির করে নিজের গরুর গোয়ালে নিয়ে বেঁধে রাখে।

ছয়.
এই এলাকার কেউ মহিষ পালে না। তবে মহিষটা আসলো কোথা থেকে। মহিষের আগমনের কথা নিয়ে শুরু হয় জল্পনা। মোতালেব বলে-
‘এটা পাঁচতলী পীরের দরগায় দেয়ার জন্য হারু মোল্লা গাবতলী হাটতে কিনছে। চাকরের হাত থেকে দড়ি ছিঁড়া পলাইছে। তারা আর খুঁইজা পায় নাই। এডা হইলো সেই মহিষ।’
‘অই তুই জানস। না আন্তাজি কথা কছ।’
মফিজ মাস্টার ধমক দেয়। চুপসে যায় মোতালেব। তার কথা যে হালে পানি পায় না তা বুঝে সটকে পড়ে সে। মোতালেবকে সটকে পড়তে দেখে রাশভারি কণ্ঠে খোরকান এসে বলে, ‘আমার মনে হয় মহিষটা কোরবানীর জন্য আনছে।’
হযরত আলী রা রা করে ওঠে।
‘বরকী ঈদের বাকী আরো তিন মাস। হেয় একটা গল্প লইয়া আইছে।’
নিজের কথার মূল্য পাচ্ছে না ভেবে খোরকান একটু রাগমিশ্রিত কণ্ঠে বলেÑ
‘কোরবানী দিতে হয় একটু মায়া লাগাইয়া। পশুর প্রতি মায়া না থাকলে হেই পশু কোরবানী দিয়া কি লাভ। যে কিনছে সে বড় ঈমানদার লোক। তোমার মতো না।’
‘আমার মতো না মানে? আমার ঈমান নাই? ঈমান নিয়া কথা। তোরে আমি অইতে দেখছি। আর তুই আমার ঈমান লাইয়া কথা কছ।’
নিজের ভাইয়ের ঈমান নিয়ে কথা বলতে শুনে হযরত আলীর তালবে এলেম ভাই বলে ওঠে-
‘অই তুই ইসলামের কি বুঝছ? অই কি বুঝছ?’
ঝগড়াটা শেষ পর্যন্ত হাতাহাতির পর্যায়ে চলে যেতে থাকলে সামাদ বক্স এসে হাজির। ধমকের সুরে বলে-
‘অই তোরা দুইজনেই এহান থেকা যা। যা কইছি।’
তারা দুইজনেই সামাদ বক্সের সামনে থেকে একটু আড়াল হয়। পরিবেশ কিছুটা শান্ত হলে সামাদ বক্স নিজের কথা পেড়ে ওঠে-
‘আমরা কালইকা একটু খোঁজ খবর নেই। কোন মালিক পাওয়া না গেলে তার পরেরটা পরের চিন্তা।’
এই কথায় সবায় সায় দেয়। সবার মনের কথাটাই সামাদ বক্স বলেছে। সবার মনে কথাটা বলতে পারে বলেই না সামাদ বক্স মহল্লার মাদবর হয়। সামাদ বক্স আবার বলে ওঠে-
‘তবে আমার মনে হয় এটা খোদাই মহিষ। যেমন তাগড়া, আর শক্তিশালী। খোদাই মহিষ ছাড়া এমন হইতে পারে না।’
কথাটার মধ্যে যুক্তি আছে মনে করে মহল্লার লোকজন শান্ত হয়ে আসে।

সাত.
হাফিজ উদ্দিন বড় পেরেশান হয়ে গেছে। তিন দিন হলো মহিষটার কোন মালিক খুঁজে পাওয়া গেলো না। প্রতিদিন মহল্লার লোকজন এই মহিষ নিয়ে নানা গল্প ফাঁদতে থাকে। মহিষটা কি সত্যি খোদাই মহিষ? এই নিয়ে আর কারো মনেই সন্দেহের অবকাশ থাকে না।

খোদাই মহিষতো ছেড়ে দেওয়া দরকার। কিন্তু মুশকিল হলো সেই মহিষ ছেড়ে দিতে সবাই নারাজ। ইতোমধ্যে চাওর হয়ে গেছে, খোদাই মহিষের গোস্ত খেলে সব রোগ ভালো হয়ে যায়। তাই সবাই মিলে খোদাই মহিষ দিয়ে খোদাই শিন্নি করতে চায়। মুরব্বিরা অবশ্য বিরোধীতা করছে।
‘খোদাই জিনিস খোদার রাস্তায় ছাইরা দিতে হয়।’
কিন্তু এই কথায় দ্বিমত পোষণ করে হাফিজ উদ্দিন। মুসলিম মেম্বারও একমত।
‘খোদাই শিন্নি করা হলে আমাদের মহল্লার একটা নাম হবে। দুই চার মহল্লার লোকজনকে শিন্নি খাওয়ানো যাবে। এতে মহল্লার ইজ্জত বাড়বে বই কমবে না।’
মুসলিম মেম্বার আরো যুক্তি দেয়।
‘তাছাড়া এটাতো আমাদের জন্য করছি না। দশজনের জন্য করছি, কোন ক্ষতি হবে না।’
মুরব্বিরা মহিষ জবেহ করার বিপক্ষে থাকার পরেও ছেলেপেলে কথা শুনে না বলে মুরব্বিরা দুই-চার কথা নিজেরা বলতে বলতে সরে যায়-
‘কলিকাল। মুরব্বিগো থেইকা পোলাপান বেশি বুঝে।’
‘বোঝুক কেউ কিছু কইয়েন না।’
মুরব্বিরা নিজেদের কথা বলে চলে যেতে থাকে। তাদের কথায় কেউ কান দেয় না। মহিষ জবেহ হবে, এলাকার যুবকরা এতে খুশি। সবাই মিলে মহাধুমধামে মহিষ জবেহ করে রান্নার আয়োজন করতে থাকে। ঈদের রাতের মতোই উৎসবে জেগে ওঠে মহল্লাবাসি। রান্না হতে থাকে। দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আসতে থাকে খোদাই শিন্নি খাওয়ার জন্য। কারণ খোদাই শিন্নি খাওয়ার জন্য কারো দাওয়াতের প্রয়োজন পড়ে না। মহল্লাবাসিও নিজেদের শক্তি সামর্থ দেখাতে বেশি বেশি করে খাওয়াতে থাকে।
‘মহল্লার একটা ইজ্জত আছে না।’

আট.
খোদাই শিন্নি খাওয়ানের সপ্তাখানেকের মধ্যে ঘটনাটা ঘটতে শুরু করে। মহল্লার পুরোনো রোগীরা খোদাই শিন্নি খেয়ে ভালো হলেও হাফিজ উদ্দিনের বুকের ভেতর এক পাষাণ জেগে ওঠে। সময় যতই গড়াতে থাকে ততই অস্থিরতা বৃদ্ধি পায় তার মনের ভেতর। কোথা থেকে এই অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, কিসের চিন্তায় তার মনের ভেতর জমা হয় কালো মেঘ, তার কোন কারণ খুঁজে পায় না। ক্রমান্নয়ে তার হৃদয় প্রকান্ড পাষাণে পরিণত হয়। চোখের সামনে তার আব্বার ইন্তেকালে সবাই কান্নায় লুটিয়ে পড়লেও হাফিজ উদ্দিন কাঁদতে পারে না। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে না এক ফোঁটা পানি। তার এই পাষাণ রোগ একসময় ছড়িয়ে পড়ে মহল্লা জুড়ে। তাদের ফসলি জমিগুলো অনাবৃষ্টিতে জ্বলে যায়। গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগিও মড়ক লেগে নি:শেষ হতে থাকে এক অজানা অভিশাপে। মহল্লার লোকজন যেনো এক পাষাণ রোগে পাথর হয়ে যায়। তাদের সামনে তাদের সন্তান মারা গেলে, মা মারা গেলেও তারা চোখের কোণে পানি জড়ো করতে পারে না। মৃত গবাদীর জন্য আকাশ বেয়ে নেমে আসে শকুনের পাল। তারা যেনো দখল করে নেবে ছোট্ট এই ত্রিশঘরের মহল্লা। তখন পোড়া মহল্লার লোকজন বৃষ্টিহীন চোখে চেয়ে থাকে আকাশের দিকে, কোথাও একচিলতে মেঘ দেখবে বলে।

নয়.
হাফিজ উদ্দিন অপরাধবোধে কুকড়ে যেতে থাকে। সে অনুধাবন করে, তার কারণেই মহল্লাবাসির চোখের দরিয়া কারবালা হয়ে গেছে। সে প্রতিদিন আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়-
‘আল্লাহগো তোমার খাওন আমি খাইছি। তোমার নামে ছাইরা দেওয়া মহিষ আমি জবাই করছি। খোদা তুমি আমারে মাফ করো।’
হাফিজ উদ্দিন কাঁদে। তার চোখে পানি নেই। তার ধানী জমির মতোই চোখ দুটি পানির অভাবে মরে যাচ্ছে। মুক্তির পথ খুঁজতে প্রায়ই সে উত্তর পাড়ায় জাকেরানের সাথে জিকিরে মশগুল হয়। নিজের পাপের কথা মনে করে ক্ষমা চায়।।

হাফিজ উদ্দিন প্রতি রাতের মতো আজও তাহাজ্জুত নামাজের পরে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়। কিন্তু আজ সে একটা জিনিস আবিষ্কার করে মনে মনে হাসে। সে কত স্বার্থপর প্রতিদিন নিজের সমস্যার কথা বলেই আল্লাহর কাছে পানা চায়। তার কারণে মহল্লার লোকজনের উপর এই লা’নত। তাদের মুক্তির জন্য একদিনও খোদার কাছে মার্জনা চায় নাই। তাদের সমস্যার কথা বলেনি আল্লাহর কাছে। এবার সে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে চিৎকার করে
‘আমি স্বার্থপর। আমি স্বার্থপর খোদা। আমি স্বার্থপর।’
হাসি থামিয়ে একসময় নিজের অজান্তেই হাফিজ উদ্দিন দুই হাত উপরের দিতে তুলে মুনাজাত করতে থাকে-
‘আল্লাহ গো আমি গুনাগার। তুমি আমারে শাস্তি দাও। তোমার আর বান্দারা কোনো গুণা করে নাই। তুমি তাগো মাফ করো। তুমি তাগো মুক্তি দাও। আমারে শাস্তি দাও খোদা। আমারে শাস্তি দাও।’
বলেই হাফিজ উদ্দিন কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তার দুচোখ বেয়ে বইতে থাকে পানির নহর। হাফিজ উদ্দিনের কান্নার আওয়াজ মহল্লার সবার কানে পোঁছে যায়। দীর্ঘদিনের পাষাণহৃদয় ভেঙ্গে কান্নার শব্দ শুনতে পেয়ে তারা শব্দটির উৎসের দিকে ছুটতে থাকে। তারপর তারা পাষাণভাঙ্গা কান্নায় যোগ দেয়, যেনো কান্নার এক বিশাল মিছিল।

দশ.
দূর পশ্চিম আকাশ বেয়ে একচিলতে মেঘ এসে মহল্লার মাথার উপর জমতে থাকে। আকাশ গর্জনে নেমে আসে বৃষ্টি। তারা ভিজতে থাকে বৃষ্টির পানিতে, চোখের পানিতে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.